ঢাকায় এখন দু’ধরনের রিকশা দেখা যায়। পায়ে চালিত বা প্যাডেল এবং ব্যাটারিচালিত। ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন ভয়ানক এক আতংকের নাম। অবৈজ্ঞানিকভাবে স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি করা এ রিকশা এখন রীতিমত মরণফাঁদ। কখন যে কার জীবন কেড়ে নেয় তার ইয়ত্তা নেই। আর এসব রিকশা নিবন্ধনহীন। চালকেরও নেই প্রশিক্ষণ। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতন হওয়ার পর রাজধানী ঢাকায় হঠাৎ করে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা অস্বাভাবিক বাড়ছে। গ্রাম থেকে অনেকে শহরমুখী হয়েছে। বিশেষ করে যারা বিগত ১৬টি বছর মানুষের উপর জুলুম নিপীড়ন করেছিল তাদের একটি অংশ রাজধানীমুখী। ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীর ট্রাফিকব্যবস্থাকে পুরোপুরি বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এমনিতেই প্রায় দু’কোটি মানুষের বসবাসের রাজধানী শহর বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহরের তকমা বহু আগেই পেয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও রাজধানী ঢাকা নাগরিকবান্ধব হয়নি; বরং বিশ্বের যে কয়টি দূষিত শহর আছে তার মধ্যে অন্যতম। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার রাজধানী ঢাকাকে উন্নয়নের নামে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে। কিন্তু উন্নয়ন হয়নি। উল্টো উন্নয়নের নামে লুটপাট আর নিজেদের পকেট ভারি করেছিল। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরিবহন ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়েছিল। একটি আধুনিক নগরী হওয়ার জন্য যত রাস্তা থাকা দরকার, ঢাকায় তত রাস্তা নেই। মানুষের চলাচলের জন্য যত ফুটপাত থাকা দরকার তত ফুটপাত নেই। যতটুকু আছে তাও আবার দোকানদার আর মোটরসাইকেল আরোহীর দখলে। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার সড়কে দ্রুত, মাঝারি, ধীরগতি সব মিলিয়ে প্রায় ১৮ ধরনের যানবাহন চলাচল করে। নতুন করে ব্যাটারিচালিত রিকশা গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রকৃত পরিসংখ্যান জানা যায়নি। কারণ এগুলো নিবন্ধনের কোন বালাই নেই। যার যখন যেভাবে মন চাচ্ছে সেভাবে স্থায়ী গ্যারেজে যন্ত্রপাতি লাগিয়ে রিকশা বানিয়ে নিচ্ছে। কম পরিশ্রম এবং বেশি টাকা উপার্জন করার সুযোগ থাকায় এ পেশায় মানুষ বেশি ঝুঁকছেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাটারিচালিত রিকশার চাপ বাড়ছে। বিগত সরকার ২০২৪ সালের মে মাসে অটোরিকশা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে চালকেরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তখন সরকার পিছু হটে। কিন্তু জনতার স্রোতের মুখে ৫ আগস্ট যখন আওয়ামী সরকার বিতাড়িত হয় ঠিক তার কিছুদিন পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে চালকেরা রাস্তা অবরোধ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এবারও সরকার পিছু হটে। কিন্তু এখন ঢাকার অলিতে গলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ছেয়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে উড়াল সড়কেও চালকেরা রিকশা নিয়ে উঠে পড়ছেন। ফলে যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা সংঘটিত হতে পারে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ব্যাটারি ও যন্ত্রচালিত তিন চাকার অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখের কাছাকাছি। আর ব্যাটারি ও যন্ত্রচালিত রিকশার সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। সুতারাং হুট করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা কঠিন। তবে সড়কের নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। যেন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকেরা বেকারত্বের অভিশাপে পরিণত না হন। প্যাডেলচালিত রিকশা আর ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকা শহরে কত সংখ্যক চলতে পারবে তার একটি সংখ্যা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কোথায় চলতে পারবে আর কোথায় চলতে পারবে না তাও নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সকল তিনচাকার ব্যাটারি ও প্যাডেলচালিত রিকশাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

ব্যাটারিচালিত রিকশা চললে আমাদের অসুবিধা নেই। নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তার বিষয়টি উদ্বেগের। গত ১৯ নভেম্বর ২০২৪ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেটিং বিভাগের ৫৩ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আফসানা করিম রাচি কলা ভবন সংলগ্ন রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সে সময় দ্রুতগামী ব্যাটারিচালিত একটি একটি রিকশা ধাক্কা দিলে আফসানা মাটিতে ছিটকে পড়েন এবং মাথায় ও মুখে গুরুতর আঘাত পান। পরবর্তীতে তার মৃত্যু হয়। এটাকে আমরা কী স্রেফ দুর্ঘটনা বলতে পারি। দুর্ঘটনায় কারও হাত থাকে না। কিন্তু যখন জেনেশুনে বিপদজনক পরিবহন রাস্তায় চালানো হয় তখন তাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। এরকম নাম না জানা বহু আফসানা ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল কিংবা বাস দুর্ঘটনায় অকালেই হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাষ্যমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যানবাহনের কারণে সারা দেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৮২টিই ছিল মারাত্মক। যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে এবারের ঈদুল ফিতরের ছুটির সময় মোট যে কয়টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার সাড়ে ১৪ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে সড়কে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল এবং তিন চাকার যানবাহনের দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বন্ধ করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয় না। আমাদের প্রয়োজন সমস্যার সমাধান করা। নতুন জঞ্জাল সৃষ্টি করা নয়। এমনিতেই দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। হঠাৎ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করলে বেকারের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। অপরাধ বেড়ে যাবে। সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।

ব্যাটারিচালিত রিকশা যেভাবে স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি হচ্ছে তার লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন। সবার আগে ব্যাটারিচালিত রিকশার রুট বন্ধ করতে হবে। রুট বন্ধ না করে শুধু পুলিশ দিয়ে ব্যাটারি চালিত রিকশার নৈরাজ্য বন্ধ হবে না বরং তার চেয়ে বেশি তৈরি হবে। যেকোন মূল্যে ব্যাটারিচালিত রিকশার যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করা প্রয়োজন। না হলে এ রিকশাগুলো গলার কাঁটায় পরিণত হবে। এগুলো একটি নীতিমালার আওতায় আনা প্রয়োজন। এসব যানবাহন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে ঢাকার গুলশান, বারিধারা সোসাইটি যেভাবে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করেছে সে পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। সেখানে রিকশার সংখ্যা নির্দিষ্ট, চালকের সংখ্যা ও নির্দিষ্ট, প্রত্যেক চালকের নির্দিষ্ট ড্রেস আছে এবং তাদেরকে কিছু প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। ফলে তারা নিয়মনীতি অনুসরণ করে রিকশা চালায়। তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ শোনা যায়নি। কারণ ভাড়া নির্দিষ্ট করা আছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের কিছু প্রশিক্ষণ দেয়া, লাইসেন্স দেয়া, ভাড়া নির্দিষ্ট করে দেয়া এবং নির্দিষ্ট এ্যারিয়ার ভেতর চালানোর সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একদল গবেষক নতুন রিকশার নকশা প্রণয়ন করেছেন। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। গত ২৭ এপ্রিল পত্রিকায় এ খবরটি মুদ্রিত হয়েছে। পত্রিকার ভাষ্য থেকে জানা যায়, নতুন রিকশাটি সাধারণ রিকশার চাইতে অনেক নিরাপদ হবে। রিকশাটির খরচ আনুমানিক দেড় লাখ টাকার মতো হবে। ব্যাটারির খরচ পড়বে ৫০-৬০ হাজার টাকার মতো। রিকশার দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ২ মিটার, প্রস্থ দেড় মিটার এবং উচ্চতা ২ দশমিক ১ মিটার। রিকশাটি এখনকার রিকশার মতোই হবে এবং ৩২৫ থেকে ৪২৫ কেজি ওজন বহন করতে পারবে। রিকশাটিতে অনায়াসে দুজন যাত্রী বসতে পারবে। মূল কথা হলো সমস্যা যত বড়ই হোক রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে ব্যাটারিচালিত রিকশার নৈরাজ্য থেকে ঢাকাবাসী পরিত্রাণ পেতে পারেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews