গাজা সংহতি আন্দোলনের সময় সোমবার দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর-লুটপাটে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে গাজায় ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে সোমবার বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিল থেকে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৪৯ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তবে সরকারের বিবৃতি আর পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে কিছু দোকান ও সুপারশপে ইসরাইলি পণ্য বিক্রি ও না রাখার জন্য এক ধরনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
যদি কোনো দোকান বা সুপারশপে ইসরাইলি পণ্য বিক্রি কওে, তবে সেগুলো ভাঙচুরেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার দোকানে দোকানে গিয়ে একদল যুবক কিছু পণ্যের ছবিসহ লিফলেট দিয়েছে। যদিও পণ্যগুলো আসলেই ইসরাইলি কি না সেটা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। তবে ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পাশপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
ভাঙচুর ও লুটপাটের পর নতুন করে ইসরাইলি পণ্য না রাখার হুমকিতে আতঙ্কে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশের জন্য বিনিয়োগ করে ব্যবসা করছেন তারা। ভাঙচুর বা লুটপাট হলে ব্যবসায়ীদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এছাড়া ইসরাইলি পণ্য নয়; এমন বিদেশি পণ্যের তালিকা দিয়েও সেগুলো দোকান থেকে সরিয়ে নিতে বলা হচ্ছে। যদিও বাটাসহ দু-একটি কোম্পানি এরই মধ্যে তাদের নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। প্রকৃত তথ্য না জেনে এ ধরনের তালিকা না ছড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন কেউ কেউ।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম পুলিশের বরাত দিয়ে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, সহিংসতা ও অবৈধ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনায় তদন্ত এখনো চলছে এবং অতিরিক্ত মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও চলছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সহিংস ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। এ হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা জননিরাপত্তা ও আইনের শাসনের প্রতি চরম অবমাননা। এসব ঘটনায় জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে দৃঢ় পদক্ষেপ হিসেবে সোমবার রাতে অভিযুক্তদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ।
পাশাপাশি, আন্দোলনের সময় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে আরও জড়িতদের শনাক্ত করার কাজও চলছে। এই অভিযান চলতে থাকবে যতক্ষণ না সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা যায়।
সরকারি বিবৃতিতে তদন্তে সহায়তার জন্য কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে তা পুলিশকে জানানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়। সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার অপচেষ্টা যারা করছে, তাদের অবশ্যই জবাবদিহির মুখোমুখি করতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
ইসরাইলি পণ্য না রাখতে হুমকি ॥ গাজা সংহতি আন্দোলনের সময় সোমবার কিছু দুর্বৃত্ত দেশের বিভিন্ন শহরে বাটা, কেএফসিসহ বিভিন্ন দোকান, রেস্তোরাঁয় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে কিছু দোকান ও সুপারশপে ইসরাইলি পণ্য বিক্রি ও না রাখার জন্য এক ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। যদি কোনো দোকান বা সুপারশপ ইসরাইলি পণ্য বিক্রি কওে, তবে সেগুলো ভাঙচুরেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে। দোকানে দোকানে গিয়ে তারা অনেক পণ্যের ছবিসহ লিফলেট দিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর ওয়ারীতে এক সুপারশপের ম্যানেজার বলেন, মঙ্গলবার কিছু টিনএজ ছেলে এসে ইসরাইলি পণ্য বিক্রি করতে নিষেধ করে গেছেন। শপে যত ইসরাইলি পণ্য আছে সব যেন এই সপ্তাহের মধ্যে সরিয়ে নেই, নয়তো তারা আমাদের আউটলেট চালাইতে দেবেন না বলেও হুমকি দিয়েছেন।
তিনি বলেন, শুধু আমাদের সুপারশপে নয়, আশপাশে দোকান এবং আরও তিনটি সুপারশপে হুমকি দিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কয়েকটি দোকানে এমন হুমকি দেওয়া হয়েছে। অনেক দোকানি নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে পুলিশকে জানাতে চাচ্ছেন না। যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সে তালিকা ধরে অনেক দোকানি ও সুপারশপ কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে সেসব পণ্য সরিয়ে ফেলেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। তবুও আমার বিভাগের সব ওসিদের ডেকেছি। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হবে। যাতে করে কেউ বিক্ষোভের নামে ভাঙচুর-লুটপাট কিংবা বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি না করতে পারে।
আন্তর্জাতিক জুতা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাটা বাংলাদেশে তাদের কয়েকটি আউটলেটে হামলার ঘটনাকে ‘ভিত্তিহীন ও মিথ্যা তথ্যের ফল’ বলে দাবি করেছে। বাটার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, বাটা কোনো ইসরাইলি মালিকানাধীন কোম্পানি নয় এবং চলমান ইসরাইল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের সঙ্গে তাদের কোনো রাজনৈতিক সংযোগ নেই।
বাটা জানায়, বাটা গ্লোবালি একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। যার মূল সূচনা হয়েছিল চেক রিপাবলিকে। আমাদের কোনো রাজনৈতিক সংঘাতের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
ভাঙচুর-লুটপাটে জড়িত ৪৯ জন গ্রেপ্তার ॥ গাজায় ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে সোমবারের বিক্ষোভ মিছিল থেকে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মঙ্গলবার সকালে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, সোমবার সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন শহরে দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে এবং পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। এআইজি এনামুল হক সাগর আরও বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এর আগে সোমবার রাতে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন শহরে দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দোষীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। আইজিপি বলেছেন, আমাদের কাছে হামলাকারীদের ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে এবং অতিদ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশ টিম এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার কোনো আইনসম্মত প্রতিবাদে বাধা দেয় না। তবে প্রতিবাদের নামে কোনো অপরাধমূলক কর্মকা- বরদাস্ত করা হবে না।
ফিলিস্তিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের নামে বাটাসহ বিভিন্ন বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অফিস-দোকান ভাঙচুর প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সারাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।
যারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে সারাদেশে এর সঙ্গে জড়িত ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে।