ভারতে এবারে মনসুন বা মৌসুমি বৃষ্টি এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এলো?

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ভারতের মুম্বাইতে এবার মনসুন এসেছে আজ (২৬শে মে), নির্ধারিত সময়ের ১৭ দিন আগে

  • Author,

    শুভজ্যোতি ঘোষ

  • Role,

    বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি

  • ৫০ মিনিট আগে

নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই এবারে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বৃষ্টিপাত বা 'মনসুন' ভারতের বিরাট একটা অংশে আছড়ে পড়েছে – অসময়ের বৃষ্টিতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে কেরালা, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রের বহু জায়গার জনজীবন।

ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে মনসুন তো এসেছে প্রায় সতেরো দিন আগে – গত মধ্যরাত থেকেই অঝোর ধারার বর্ষণে মহানগরী এক কথায় বিপর্যস্ত!

শহরে যানবাহন, ট্রেন ও বিমান পরিষেবা কিছুই প্রায় ঠিকঠাক চলছে না। দক্ষিণের আর এক মেট্রো শহর ব্যাঙ্গালোরেও প্রায় একই হাল।

ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বা আইএমডি মুম্বাই এবং কেরালার ১৪টি জেলায় 'রেড অ্যালার্ট' জারি করেছে – যার মানে অতি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য প্রশাসন ও নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, মুম্বাইতে মনসুন সময়ের চেয়ে তাড়াতাড়ি আসার আগেকার সব রেকর্ডই এবার ভেঙে দিয়েছে।

মনসুন এমনিতে শহরে আসার কথা ১১ জুন নাগাদ – সেই জায়গায় এ বছর মুম্বাইতে আজই, ২৬শে মে মনসুন ঢুকে পড়েছে, সুতরাং যখন আসার কথা তার প্রায় ১৭ দিন আগে থেকেই শহরে মৌসুমি বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে।

প্রবল মৌসুমি বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মুম্বাইয়ের যান চলাচল

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

প্রবল মৌসুমি বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মুম্বাইয়ের যান চলাচল

ভারতের স্বাধীনতার পর আইএমডি সেই ১৯৫০ সাল থেকে মনসুনের রেকর্ড রাখছে – আর এতকালের মধ্যে মুম্বাইতে মনসুন কখনওই এত তাড়াতাড়ি আসেনি।

এর আগে মুম্বাইতে মনসুনের সবচেয়ে তাড়াতাড়ি আসার রেকর্ড ছিল ২৯শে মে – যে ঘটনা ঘটেছিল তিনবার - ১৯৫৬, ১৯৬২ ও ১৯৭১ সালে। ফলে এ বছর বহু পুরনো একটি আবহাওয়াগত রেকর্ড ভাঙল।

আবহবিদরা ধারণা করছেন, যেহেতু ভারতের প্রায় পুরো পশ্চিম উপকূল জুড়েই সময়ের অনেক আগে মনসুন প্রবেশ করে গেছে – তাই বাংলাদেশ-সহ ভারতীয় উপমহাদেশের বাদবাকি সব অংশেই মনসুন এবারে অন্যবারের তুলনায় বেশ তাড়াতাড়ি আসবে।

তবে কোন জায়গায় ঠিক কতটা তাড়াতাড়ি, তা এখনই নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না।

কিন্তু কোন আবহাওয়াগত প্রক্রিয়ায় এই ঘটনাটা সম্ভব হল? আর এবারের মনসুনে উপমহাদেশ জুড়ে বৃষ্টির পরিমাণই বা কতটা হতে পারে?

সাধারণত দেশে মনসুন কোন সময়ে আসে?

ভারতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌশুমি বৃষ্টি বা মনসুন প্রবেশ করে কেরালা উপকূল দিয়ে – আর বহু বহু বছরের রেকর্ড বলছে কেরালাতে মনসুন আছড়ে পড়ার গড় তারিখটা হল ১লা জুন।

এরপর মনসুন ক্রমশ কোঙ্কন উপকূলের দিকে ধাবিত হয় – আর মহারাষ্ট্রে পৌঁছে যায় ১০ জুন নাগাদ।

প্রাক-মনসুন বৃষ্টি চলছে কলকাতাতেও। ২৫শে মে রোববারের ছবি

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

প্রাক-মনসুন বৃষ্টি চলছে কলকাতাতেও। ২৫শে মে রোববারের ছবি

মুম্বাই উপকূলে মনসুন পৌঁছানোর তারিখ ধরা হয় এর পরদিন, ১১ জুন। যার মানে কেরালা থেকে মুম্বাইতে পৌঁছতে মনসুনের সাধারণত দিনদশেক সময় লাগে।

এবার যে মনসুন কেরালাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রবেশ করবে, আইএমডি অবশ্য আগেই সেই পূর্বাভাস করেছিল।

দিল্লিতে আইএমডি-র বিজ্ঞানী নীথা কে গোপাল জানাচ্ছেন, "আমরা এবার অনেক আগেই ফোরকাস্ট করেছিলাম ২৭শে মে নাগাদ কেরালায় মনসুন হিট করবে। এই পূর্বাভাসে অবশ্য চারদিনের মার্জিন অব এরর থাকে – মানে মনসুন এই তারিখের চারদিন আগেও ঢুকতে পারে, আবার চারদিন পরেও ঢুকতে পারে।"

বাস্তবে অবশ্য দেখা গেছে ২৭শে মে-র আগেই কেরালা তো বটেই, ২৬শে মে-র মধ্যে মনসুন মুম্বাই পর্যন্ত পৌঁছে গেছে!

নীথা কে গোপালের কথায়, "কেরালায় মনসুন প্রবেশ করেছে ২৪শে মে। ফলে এটা আমাদের পূর্বাভাসের যে মার্জিন অব এরর – তার ভেতরেই আছে এবং আমাদের হিসেবে কোনও ভুল ছিল না।"

২০০৯ সালের পর এত আগে মনসুন কখনো ভারতে প্রবেশ করেনি – তবে সপ্তাহখানেক আগে মনসুন ঢুকে পড়াটা তবু তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়!

মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় জলের ভেতর দিয়ে বাইসাইকেল ঠেলে অফিস যাওয়ার চেষ্টায় একজন নিত্যযাত্রী

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

মুম্বাইয়ের বান্দ্রায় জলের ভেতর দিয়ে বাইসাইকেল ঠেলে অফিস যাওয়ার চেষ্টায় একজন নিত্যযাত্রী

কিন্তু এর পরের ঘটনাটাই আসলে আবহবিদদের সবচেয়ে আশ্চর্য করেছে – যে কেরালা থেকে মাত্র দু'দিনের ভেতরে মনসুন মুম্বাই অবধি পৌঁছে গেছে, অন্য সময় যেটা ঘটতে প্রায় দিনদশেক সময় লেগে যায়!

মনসুন এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এগোতে পারলো?

আইএমডি মুম্বাই কার্যালয়ের প্রধান শুভাঙ্গী ভুটে বিবিসিকে জানিয়েছেন. 'খুব ফেভারেবল' বা সুবিধাজনক আবহাওয়াগত পরিস্থিতি ছিল বলেই মনসুন এবার এত আগে চলে এসেছে ('আর্লি অনসেট') – আর ঝড়ের গতিতে পশ্চিম উপকূল ধরে এগোতে পেরেছে ('ফাস্ট প্রোগ্রেশন')!

বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে 'ম্যাডেন-জুলিয়ান অসিলেশন' (এমজেও) নামে একটি প্রক্রিয়া – যা এবছর ভারত মহাসাগরে অতি সক্রিয় ছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতি বছরের মনসুনকে যে ফ্যাক্টরগুলি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে থাকে – এমজেও তার অন্যতম।

ম্যাডেন-জুলিয়ান অসিলেশন বা (এমজেও) হল আসলে বাতাস, মেঘ আর বায়ুচাপের একটি অত্যন্ত জটিল চলমান আবর্ত (মুভিং সিস্টেম) – যা ভারত মহাসাগরে তৈরি হয় এবং প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে ৮ মিটার গতিতে পূর্বদিকে এগোতে থাকে।

মাত্র ৩০ থেকে ৬০ দিনের ভেতর এই এমজেও-র উইন্ড ব্যান্ডগুলো সারা পৃথিবী পরিক্রমা করে ফেলতে পারে – আর যেখানেই এটা যায়, সেখানেই আবহাওয়ার বড়সড় পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

এ বছরের মনসুন কীভাবে এগোবে – ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস মানচিত্র

ছবির উৎস, IMD

ছবির ক্যাপশান,

এ বছরের মনসুন কীভাবে এগোবে – ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস মানচিত্র

এমজেও যদি সহায়ক ভূমিকায় থাকে, তাহলে সেই বছরগুলোতে মনসুনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হতে দেখা যায়। বস্তুত চলতি বছর ২০২৫ও ছিল এরকমই একটি বছর।

বস্তুত গত ২২শে মে তারিখেই আইএমডি তাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলেছিল ভারত মহাসাগরে তখনই এমজেও শক্তিশালী চতুর্থ পর্যায়ে (ফেজ ফোর) ছিল – আর তার অ্যামপ্লিচিউড-ও ছিল ১-র বেশি, যা প্রবল বৃষ্টিপাত ও ঝড়ঝঞ্ঝার আভাস দেয়।

শুভাঙ্গী ভুটে বলছিলেন, "একদিকে যেমন এমজেও সহায়ক ভূমিকায় আছে, তেমনি এই মুহুর্তে ক্রস ইক্যুয়েটোরিয়িাল উইন্ডও খুব শক্তিশালী – যা বাতাসে অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প নিয়ে আসছে এবং আরও বৃষ্টি এনে দিচ্ছে।"

প্রসঙ্গত, ক্রস ইক্যুয়েটোরিয়িাল উইন্ড হলো সেই বাতাস যা পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের মধ্যে তাপ আর জলীয় বাষ্প বয়ে নিয়ে বেড়ায়।

এই দুটো ফ্যাক্টরের পাশাপাশি আরব সাগরে সাইক্লোনিক সার্কুলেশনের ফলে সম্প্রতি একটি নিম্নচাপও সৃষ্টি হয়েছিল – আইএমডি-র বিজ্ঞানীদের মতে এটিও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌশুমি বায়ুর গতিবেগ বাড়াতে সাহায্য করেছে।

সোমবার প্রায় পুরো দিনই অচল হয়ে ছিল মুম্বাইয়ের পথঘাট

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

সোমবার প্রায় পুরো দিনই অচল হয়ে ছিল মুম্বাইয়ের পথঘাট

বস্তুত আরব সাগরের এই নিম্নচাপের কারণেই গত বেশ কিছুদিন ধরেই মুম্বাই ও তার আশেপাশে 'প্রাক-মনসুন' বৃষ্টি চলছিল।

সুতরাং এই তিনটে কারণের 'ত্র্যহস্পর্শ' যোগেই মুম্বাইতে এবার সব পুরনো রেকর্ড ভেঙে মনসুন এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে বলে আবহবিদরা ধারণা করছেন।

আরও বেশ কয়েকটি কারণে সারা দেশেও এবার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মৌশুমি বৃষ্টিপাত হবে বলে আইএমডি অনুমান করছে।

মনসুনে তাদের এ বছরের পূর্বাভাস হল 'লং পিরিওড অ্যাভারেজ (দীর্ঘমেয়াদি গড়) বা এলপিএ-র ১০৫%, যদিও তাতে মার্জিন অব এরর সেই ৫ শতাংশের মতো।

মানে মোট বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক বা তার চেয়ে দশ শতাংশ বেশির মধ্যেই থাকবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews