গত ৯ অক্টোবর আরাকানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আক্রমণে ৯ পুলিশ সদস্যসহ কয়েকজন সেনা সদস্য নিহত হওয়ার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী সন্ত্রাস দমনের নামে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বাড়িঘর প্রজ্বলন এবং বিতাড়নের মাধ্যমে জাতিগত উচ্ছেদে মেতে উঠেছে। গণতন্ত্রের ‘মানস কন্যার’ দেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসী প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক ব্যর্থতা বা সদিচ্ছার অভাবে রোহিঙ্গা ইস্যু বিশ্বের জন্য মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে।মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা দীর্ঘদিন থেকেই শোষণ, জুলুম ও নির্যাতনের শিকার। দেশটির ক্ষমতাসীনরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে প্রচার করছে এবং তাদের বাংলাদেশে বিতাড়ন করছে। ‘বিবেকের দূত’ হিসেবে খ্যাত অং সান সুচি এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করছেন। রোহিঙ্গা মুসলিম এলাকায় বিদেশী সহযোগিতা যাতে পৌঁছাতে না পারে তার সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য মানবাধিকার গোষ্ঠী ও বিদেশীদেরও সেখানে প্রবেশে বাধা দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি আল জাজিরায় প্রদর্শিত একটি ভিডিওচিত্রে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে তাদের গ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছে। হাত-পা বাঁধা জীবন্ত মানুষ সেই জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে ছারখার হচ্ছে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা দলে দলে পালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, দুগ্ধপানরত একটি শিশুর মাকে বিতাড়নকারী সেনা সদস্য তাড়া করছে।গত ২৮ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে বর্মীদের অত্যাচারের যে লোমহর্ষক দৃশ্যের বর্ণনা করা হয়েছে তা এ রকম : আরাকানের হাতিপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের সবাইকে শান্তি আলোচনার জন্য মিটিংয়ে আহ্বান করা হয় গত ২৫ নভেম্বর। এরপর সমবেত নারী-পুরুষ সবাইকে উলঙ্গ করে পুরুষদের চোখ বেঁধে বেয়নেট দিয়ে রক্তাক্ত করা হয় এবং নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে অনেক নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়। সৈন্যদের অস্ত্র নিয়ে উন্মত্ত রাখাইন যুবকরা বাড়িঘর লুট করে এবং লুটপাট শেষে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বাবা-মা, ভাই-বোনের সামনেই কিশোরী-তরুণীদের গণধর্ষণ করে। বর্মী সৈন্য ও রাখাইন যুবকরা একযোগে এসব তাণ্ডব ও সহিংসতা চালিয়ে উদ্ধতকণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে : তোদের জন্য যেসব দেশ ও সংস্থা মায়াকান্না দেখাচ্ছে তাদের খবর দে... ওরা না আসা পর্যন্ত তোদের ওপর এ অত্যাচার চলবে। বর্মীদের নৃশংসতার আরও যেসব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে তার সবটা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সেসব করুণ দৃশ্য পাঠকদের কল্পনার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করছি।রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় সম্পর্কে প্রচলিত বা মিয়ানমার সরকার প্রচারিত একটি ভুল তথ্য শুধরে দিতে চাই। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে যায়নি। তারা আরাকানের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ, বরং বর্মীরাই সেখানে বহিরাগত ও তস্কর। এক পলক ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখুন। বর্মী রাজারা প্রায়ই এ এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করতে চেষ্টা চালাতেন। মূলত হিন্দু রাজা ও মুসলিম সুলতানরা এ এলাকা শাসন করতেন। এর পাশেই ছিল প্রতিবেশী বর্মীরাজ্য। আরাকান পাহাড় এ রাজ্য থেকে আরাকানকে বিছিন্ন করে রেখেছিল। একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১০৪৪-১০৭৭) বর্মী রাজা আনাওরথার এ অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়নের মাধ্যমে এলাকাটি দখল করেন। পরবর্তীকালে গৌড়ের সুলতানদের সহায়তায় বিতাড়িত হিন্দু রাজা লারামেখালা ১৪৩০ সালে আরাকানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আরাকান শাসন করতে থাকেন। ১৭৮৫ সালে বর্মীরা আবার আরাকান দখল করে নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালায়। এরপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজদের হাতে চলে যায় এ এলাকা। স্বাধীনতার পর মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রথম প্রেসিডেন্ট উ লু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ওই দেশের বাসিন্দা হওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৪৭ সালের প্রথম সংবিধান সভার নির্বাচনে রোহিঙ্গারা ভোট দিয়ে তাদের নাগরিকত্বের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর ১৯৫১ সালে তারা জাতীয় পরিচয়পত্রও পান। কিছু বর্মী এ ব্যাপারে আপত্তি করলে প্রধানমন্ত্রী উ বা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অন্যতম জাতিগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করেন। এমনকি স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শাও শোয়ে থাইক রাগান্বিত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি মিয়ানমারের স্থানীয় অধিবাসী না হয়ে থাকেন, তাহলে আমিও এর নাগরিক নই।’ষাটের দশকে মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরু হলে ‘ড্রাগন কিং’ অপারেশনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা শুরু হয় এবং অদ্যাবধি সে নির্যাতন চলছে। সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রকৃতি ও ব্যাপকতা দেখে মনে হয় এই জাতিগোষ্ঠীর বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত এ নির্যাতন চলবে। ইতিমধ্যে এ নির্যাতনকে বিশ্ব মিডিয়া এবং মানবাধিকার ও গবেষণা সংস্থাগুলো ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ ও ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক সরেজমিন এক গবেষণাকর্মে বর্ণনা করেছে, মিয়ানমারে ‘আইনসিদ্ধ গণহত্যা’ চলছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসও এমন অপরাধের বর্ণনা দিয়েছে। জাতিসংঘের মতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বিশ্বের সবচেয়ে বঞ্চিত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী, তাদের রাষ্ট্রহীন করে রাখা হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকের পরিচালক মার্ক ফার্মেনার মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি লন্ডনস্থ মিয়ানমার দূতাবাসে অবহিত করেছেন এবং এর প্রতিকার চেয়েছেন। গত ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে রোহিঙ্গা নির্যাতনকে মানবাধিকারের চরম লংঘন হিসেবে অভিহিত করা হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইটে ধারণ করা দৃশ্য বিশ্লেষণ করে মিয়ানমারের সৈন্যদের হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে রোহিঙ্গা হত্যার দৃশ্যসহ অন্যান্য ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ সচিত্র প্রতিবেদন পেশ করেছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও জাতিসংঘসহ সবাই এ অপরাধের বিচার দাবি করছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে দাবি করা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সঙ্গত কারণেই রোহিঙ্গা নির্যাতনের অপরাধ ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে।রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বর্মী সৈন্যদের চালানো গণহত্যা, মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতিগত নিধনযজ্ঞ- এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন মহল সোচ্চার। প্রশ্ন হল, তাহলে এ অত্যাচার বন্ধ হচ্ছে না কেন? এর নেপথ্যে রয়েছে এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি এবং মিয়ানমারে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ। ভারতের দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, ‘চীনকে ঘেরাও করো’- এ মার্কিন ও পশ্চিমা নীতি বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার ভূখণ্ড প্রয়োজন এবং সে কারণে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলো মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। তাদের স্বার্থবাদী নীতির কাছে মানবতাবাদ হচ্ছে পরাজিত। আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি যেমন ভারত ও চীন সম্ভবত একই ভূ-কৌশলগত এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে তাদের পররাষ্ট্রিক সংশ্লিষ্টতার কারণে মিয়ানমারের প্রতি তোষণনীতি অনুসরণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি ভারত পাশ্চাত্যের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-এশীয় নতুন মিত্ররাষ্ট্র। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফোর্টিফাই চায়না’ নীতির সমর্থক হিসেবে তথা কৌশলগত পার্টনার হিসেবে সম্ভবত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তেমন সোচ্চার হবে না। আর দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ার পরাশক্তি চীনও তার স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নির্যাতন মেনে নেবে। চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে জ্বালানি পাইপলাইনটি রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার নিচ দিয়ে প্রসারিত। ২০১২ সাল থেকে মিয়ানমার সরকার এ পাইপলাইনের নিরাপদ স্থাপনার জন্য এ অঞ্চলের বসতবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা উচ্ছেদের কার্যক্রম হাতে নেয়, যার চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে সম্ভবত এবার। তেল-গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে নিজ স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থেই চীন হয়তো এখন নীরব থাকবে। তাছাড়া উইঘুরে (চীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল) মুসলিম নির্যাতনের রক্তে রঞ্জিত চীন সরকারের নৈতিক অধিকারও নেই মিয়ানমারকে শাসানোর। উল্লেখ্য, চীন ও মিয়ানমার উভয় রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।মিয়ানমারের কাছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে উদ্যোগ নিতে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এ সবকিছু সত্ত্বেও বর্মী সেনাবাহিনী ও উদ্ধত রাখাইন যুবকদের নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগ এবং জোরালো কূটনীতিই পারে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে বাধ্য করতে। আমরা কি সেই সুবিচার দেখতে পাব?মুহাম্মদ রুহুল আমীন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়