কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
কুষ্টিয়া ও রাজধানী ঢাকায় সেনা অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে। এ সময় সুব্রত বাইনের দুই সহযোগীকেও আটক করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকায় জেলা কারাগারের পেছনের একটি মেস বাড়ি থেকে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে সেনাবাহিনীর অভিযানে এক সহযোগীসহ সুব্রত বাইনকে আটক করা হয়। ওই বাড়িতে আত্মগোপনে থাকা সুব্রত বাইনকে গ্রেফতারের বিষয়টি বিকেলে আইএসপিআরের সংবাদ সম্মেলনে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গ্রেফতারের সময় সুব্রত বাইনের এক সহযোগী এবং পাঁচটি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিনসহ চার রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়েছে। গতকাল ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত শহরের কালীশংকপুর এলাকায় সোনার বাংলা মসজিদের পাশের একটি বাড়িতে এ অভিযান চালানো হয়। এলাকাবাসী জানান, মঙ্গলবার ফজরের নামাজের পর সেনাবাহিনীর ছয়টি গাড়ির বহরে ২০ থেকে ৩০ জন সেনাসদস্য কালিশংকপুরে মীর মহিউদ্দিনের তিনতলা বাড়ির দোতলা ও তিনতলায় ওঠে সেখানকার মেসের শিক্ষার্থীদের একটি কক্ষে রাখেন। এ সময় এক সেনাকর্মকর্তা মেসের শিক্ষার্থীদের বলেন, তোমাদের কোনো ভয় নেই। তোমরা চুপচাপ বসে থাকো। এখানে সেনা অভিযান চলছে। তিন ঘণ্টা ধরে নিচতলায় তল্লাশি চলে। সকাল ৮টার কিছু সময় পর নিচতলা থেকে দাঁড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে হাতকড়া পরা ও মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় কালো মাইক্রোবাসে তোলা হয়। আরেক যুবকের কোমরে ও শরীরে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। ওই মেসের শিক্ষার্থীরা সেনাবাহিনীর নিকট কাকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানতে চাইলে তারা উত্তরে জানান, নাম বললে ভয় পাবা, পরে মিডিয়ায় জানতে পারবা। মেসে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বাড়িটির দোতলা ও তৃতীয় তলায় কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা থাকত। মাস দেড়েক আগে মেস বাড়ির পেছনের বাড়ির মালিক হেলাল নামের একজনকে সেখানে ভাড়াটিয়া হিসেবে নেন। দুই সপ্তাহ আগে অতিথি পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তিকে রেখে যান। নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন, তা কখনো তারা দেখেননি। তবে একজনকে দিনে দুই-একবার বাইরে বের হতে দেখা গেছে।
কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, ‘আমাদের কোনো অভিযান ছিল না। এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।’
এ দিকে গতকাল বিকেলে কুষ্টিয়া শহরের মেস এলাকা হিসেবে পরিচিত কালিশংকপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার পরিবেশ ছিল থমথমে। সকালে সেনাবাহিনীর অভিযান নিয়ে সারাদিনই এলাকার মানুষের মধ্যে কৌতূহল ছিল। আটক সন্ত্রাসীকে হতে পারে এমন প্রশ্ন সংবাদকর্মীসহ সব মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। দুপুরের পর থেকে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় আটক ব্যক্তি সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ। তবে নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র না পাওয়ায় সংবাদকর্মীদের মধ্যেও ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ায় সংবাদকর্মীরা পড়েন বিপাকে। তবে ঢাকার সাংবাদিকদের বরাত দিয়ে মিডিয়ায় আটক ব্যক্তি সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ বলে সকলে নিশ্চিত হওয়ার পর এলাকায় মানুষের আনাগোনা ও কৌতূহল বৃদ্ধি পায়। মেসের শিক্ষার্থীরা জানান, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আমাদের মেসের নিচতলায় অবস্থান করছিল একথাটি ভাবতেই অবাক লাগছে। গা শিউরে ওঠার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা খুব কমই রুম থেকে বের হতো। আমাদের সাথে কোনো কথা হতো না। খাবারের সময় তাদের বাইরে বের হতে দেখা যেত, তবে একসাথে কাউকে দেখা যায়নি। আমরা কর্মজীবী মনে করে কখনো তাদের সাথে মেলামেশার আগ্রহী হতে পারিনি।
কালিশংকপুরে কয়েক শত মেস বাড়ি গড়ে উঠেছে। সেখানে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মেস বেশি। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, মহিলা কলেজ, সরকারি সেন্ট্রাল কলেজ, পলিটেকনিক, ইসলামী বিশ^দ্যিালয়সহ বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালের নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মজীবী ও শিক্ষার্থীদের আবাসস্থল এলাকার মেস ঘিরে। মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকে আশপাশের মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল এই বাড়িটি ঘিরে। এ দিকে জানা গেছে, আলোচিত বাড়িটির নিচতলা যিনি ভাড়া নিয়েছিলেন তার নাম হেলাল উদ্দিন। তিনি বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে এলাকাবাসী জানান। তবে এই ঘটনার পর থেকে হেলাল গাঢাকা দিয়েছে।
আইএসপিআরের ব্রিফিং
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং পরিকল্পনায় গ্রেফতার করা হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে। গতকাল বিকেলে সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী। তিনি বলেন, গতকাল ভোর ৫ টা থেকে শুরু হওয়া কুষ্টিয়া ও হাতিরঝিলে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে ৪৬ স্বতন্ত্র ইনফ্রেন্ট্রি ব্রিগেডের একটি ইউনিট গোপন তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং তাদের দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
আটকরা হলেন, দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী, আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ এবং শ্যুটার আরাফাত ও গাড়ি চালক শরীফ। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৫টি বিদেশী পিস্তল, ১০ টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি এবং ১টি স্যাটেলাইট ফোন।
সেনা কর্মকর্তা বলেন, এই চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যা, চাঁদাবাজি এবং নাশকতা চালিয়ে আসছিল। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ হলো তালিকাভুক্ত ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী দলের অন্যতম নেতা এবং সেভেন স্টার চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী। এই অভিযান ছিল দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং পরিকল্পনার ফসল। অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ে ও সহায়তা প্রদান করেছে সেনা সদরের সামরিক অপারেশন পরিদফতর, ৫৫ পদাতিক ডিভিশন, ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড, ৭১ মেকানাইজ ব্রিগেড ও এনএসআই।