রাজনীতি আগ্রহী সবার নজর এখন চট্টগ্রামের দিকে। সিটি করপোশনের নির্বাচন সামনে রেখে চট্টগ্রামে এখন টানটান উত্তেজনা। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে। আওয়ামী লীগ চাইছে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে। বিএনপিও পরাজয় মানতে নারাজ। তবে যারা রাজনীতির ভেতরের খবর রাখেন, তারা জানেন কী হবে নির্বাচনের ফল। আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার জন্য নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে – এটা যারা ভাবেন, তারা ভাব সাগরে ডুবে আছেন। প্রশ্ন হলো, ফলাফল যদি আগেই নির্ধারিত থাকে তাহলে সেই নির্বাচন হওয়া, না-হওয়া নিয়ে এত উত্তেজনা, হাকডাক কেন?
নির্বাচন হওয়া একটি নিয়ম। সেই নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন হতে হয়। তাই নির্বাচন হচ্ছে। গণতন্ত্র এক মজার জিনিস। কোনোভাবে একজনের সমর্থন বেশি পেলেই কেল্লাফতে। কীভাবে এই সমর্থন আদায় করা হয়, সেটা বড় বিবেচনার বিষয় নয়, বড় হলো একজনের বেশি সমর্থন। সংখ্যা বেশি হলেই হলো, গুণ বিচারের কিছু নেই। তাই সবাই জেতার জন্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নীতি-নৈতিকতার চেয়ে জয়টাই প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু জয় তো হয় একজনেরই। সেই একজন যে সব সময় জনগণের পছন্দের হয়ে থাকেন, তা নয়।
গত কয়েক বছরে নির্বাচন ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এখন আর সব ক্ষেত্রে সবাই নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন না। যারা ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো' স্লোগান দিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির আন্দোলন করেছেন, তারাই এখন সেই স্লোগান থেকে সরে এসেছেন।
নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আমাদের দেশে সব সময়ই ছিল। তবে নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং দ্বন্দ্ব-বিরোধের পরিণতিতে নির্বাচন এখন আমাদের দেশে ভিন্ন রূপ এবং মাত্রা পেয়েছে। আজকের অবস্থা কেন তৈরি হলো, এরজন্য দায় কার – সেসব নিয়ে বিতর্ক আছে এবং থাকবে। নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের অবসান কবে, কীভাবে ঘটবে, তা এখনই বলা মুস্কিল। কেউ কেউ মনে করেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বিতর্কমুক্ত নির্বাচন খুব সহসা হওয়ার লক্ষণ নেই।
এ বিষয়ে লম্বা বিতর্কে না গিয়ে এই মুহূর্তে যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে সেটা হলো, কেমন হবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন? সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হবে, নাকি সহিংসতা ও গোলযোগের মধ্য দিয়ে ভোট শেষে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে? চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ হবে ২৭ জানুয়ারি। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শেষ করেছেন। তবে একদল, আরেক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এমন পর্যায়ে নিয়েছে যে, মানুষের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন। নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেছেন, ‘সভায় বিজিবি, আনসার , র্যাব এবং গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের বক্তব্য আমরা শুনেছি। নির্বাচনী পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। প্রত্যেকেই আশা করছেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে। আমরা আশ্বস্ত হয়েছি, বিভিন্ন পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন সঠিকভাবে হয়েছে। আশা করি, নির্বাচন ভালো হবে'।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে ভালো নির্বাচন আশা করলেও সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছেন বলে মনে হয় না। ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের যে শক্ত অবস্থা গ্রহণ করা দরকার, নির্বাচন কমিশন তা দেখাতে পারছে না। নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা, উদাসীনতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে পক্ষপাতের কারণেই ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠান দুরূহ হয়ে উঠেছে।
ভোটকেন্দ্রে একতরফা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে কালচারকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তা চট্টগ্রামে বদলে যাবে বলে মনে হয় না। বিএনপি অভিযোগ করছে, তাদের কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আবার আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপি পলাতক জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংগঠিত করছে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য। এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পরিণতিতে শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি কতটা শান্ত থাকে এবং ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কেমন হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এটা ঠিক যে, নির্বাচনী প্রচারে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ পরিকল্পত ও সংগঠিতভাবে মাঠে দৃশ্যমান আছে। কিন্তু বিএনপির প্রচারণা অসংগঠিত, এলোমেলো। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা কার্যত নির্বাচনী প্রচার থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী একাই সব কিছু সামলাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনে জয় ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নেই। কিন্তু বিএনপির লক্ষ্য দ্বিমুখী। জিতলে ভালো, হারলেও ভালো। জিতলে বলবে, সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন নেই। হারলে বলবে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
চট্টগ্রামে দুই দলেরই অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। কমিশনার পদে আছে অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী। বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দিয়েও লাভ হয়নি। এই বিদ্রোহীরা একদিকে দলের গলার কাটা, অন্যদিকে এদের প্রতিযোগিতার কারণেই নিজেদের মধ্যে হানাহানি, মারামারিও হয়। তবে মেয়র পদে দুই দলই নিজেদের ভালো প্রার্থীকেই মনোনয়ন দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী একসময় ছাত্রলীগ করতেন। রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়া তিনি তা থেকে দূরে। ফলে সাধারণভাবে তার ইমেজ পরিচ্ছন্ন। তার ক্যাডার বাহিনী নেই বলেও শোনা যায়। আবার বিএনপির ডা. শাহাদাতও দলের মধ্যে তুলনামূলক ভালো লোক বলেই প্রচার।
ভোট অবশ্য এখন আর প্রার্থী দেখে হয় না। দল এবং মার্কা বা প্রতীক হলো নিয়ামক বিষয়। নৌকা এবং ধানের শীষ– শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই দুই প্রতীকের মধ্যেই। দলীয় প্রতীক নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যবস্থা ভালো, না মন্দ সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে। যারা এক সময় দলীয় প্রতীক নিয়ে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে চ্ছিলেন, তারাও এখন দ্বিতীয় চিন্তা করছেন। তবে সহসাই আবার এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে বলেও মনে হয় না। আমরা যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলি, সেই ব্যবস্থাকে আঁকড়ে থাকতেও পছন্দ করি।
চট্টগ্রামে সিটি নির্বাচন কেমন হবে জানতে চেয়েছিলাম আমার পরিচিত এক রাজনৈতিক বন্ধুর কাছে। তিনি বললেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নির্বাচন যেমন হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটিতেও তার ব্যতিক্রম হবে না। বাহ্যত পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের অনুকূলে। শতভাগ ‘ফেয়ার' নির্বাচন হবে বলে কেউ আশা করে না। তবে চোখে লাগার মতো অনিয়ম এড়ানোর চেষ্টা আছে।
বললাম, শেখ হাসিনার সরকার এতসব উন্নয়ন করছেন, এই যে ৬৬ হাজারের বেশি ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে জমি এবং ঘর উপহার দেওয়া হলো, পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণসহ কত বড় বড় প্রকল্প– তারপরও ভোটে জেতার জন্য তো আওয়ামী লীগের দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়।
আমার বন্ধুটি হেসে জবাব দিলেন, আমাদের সমাজ এবং জনমনস্তত্ত্বে একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে বা ঘটছে। শেখ হাসিনা যদি সব ভোটারকে স্বর্ণের হারও উপহার দেন, তবু ফেয়ার নির্বাচনে নৌকার জেতা নিয়ে সংশয় দূর হবে না। আর এই সংশয় থাকলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অধরা থাকবে না তো কি?
বুঝহ সুজন যে জানো সন্ধান!
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/এমকেএইচ