আমি একসময় অনেক টিভি নাটক দেখতাম। ভালো লাগত। কৈশোর ও যৌবনে অনেক টিভি সিরিয়ালও দেখেছি। ‘এই সব দিন রাত্রি’, ‘আজ রোববার’, ‘বহুব্রীহি’ ইত্যাদি সিরিয়াল মনোযোগ সহকারে দেখতাম। একেকটি এপিসোড শেষ হলে আরেকটি এপিসোডের জন্য অপেক্ষা করতাম। এখনো টিভিতে সিরিয়াল হয়। তবে দেখতে চাইলে মন বসাতে পারি না। এখনো নাটক হয়। মাঝেমধ্যে দেখি। খুব বেশি ভালো লাগে না।
তার মানে বলছি না যে, ভালো নাটক হচ্ছে না। এখনো কিছু ভালো নাটক হচ্ছে। অভিনয়শিল্পীরা গুণী। তাদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলা বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করে অভিনয়ে এসেছেন। তারপরও নাটকের মানে প্রত্যাশিত উন্নতি হচ্ছে না কেন? টেলিভিশনে বেশির ভাগ নাটকেই দেখি কমেডির প্রচেষ্টা। এগুলোকে কমেডি বলতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু হাসি না এলে কেমন করে কমেডি বলব?
কমেডি এবং প্রেম-এ দুটি বিষয়কে ঘিরেই গড়ে ওঠে অধিকাংশ নাটকের বিষয়বস্তু। রাজনৈতিক বঞ্চনা, দুর্নীতি, সংগ্রাম, নিপীড়ন, প্রতিবাদ এবং শোষণও তো জীবনের অংশ। সেসব বিষয়ের ওপর নাটকের সংখ্যা অপ্রতুল।
আমি নাট্য সমালোচক নই। কাজেই এসব বিষয়ের আলোচনা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার এ লেখার বিষয়বস্তু হলো নাট্যপরিচালকদের পেশাদারি ও ভদ্রতাজ্ঞান নিয়ে। আমি রাজনীতির শিক্ষক। সেজন্য শিক্ষক হিসাবে পেশাগত উন্নতি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় দায়িত্ব পালনের জন্য আমাকে লেখালেখি করতে হয়। আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী তা করি।
কিন্তু সেসব লেখার বেশির ভাগই আমার একাডেমিক ডিসিপ্লিনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব রাজনীতি, সামাজিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে আমি বেশকিছু গ্রন্থ, গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং পপুলার রাইটিং করেছি। সেগুলো দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। সংগীত ও নাটক আমার লাইন নয়। তবে আমি নাট্যভক্ত দর্শক।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর গৃহবন্দি অবস্থায় নাটক নিয়ে যেমন আরও বেশি ভাবছি; তেমনি নাটক দেখা হচ্ছে বেশি। ২০২০-এ দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়লে গৃহবন্দি অবস্থায় নাটক দেখে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি। এ সময় আমি যত নাটক দেখেছি, তার বেশির ভাগ ইউটিউবে। তবে টিভি নাটকও কম দেখিনি।
ইউটিউবে কোভিডকালীন যেসব নাটক দেখেছি, ওই নাটকগুলোয় অভিনয়শিল্পীরা ভালো অভিনয় করেছেন। তবে অধিকাংশ নাটকের স্ক্রিপ্ট আমার কাছে দুর্বল মনে হয়েছে। নাট্যকার তার নাটকে সমাজ বা দর্শকদের কী মেসেজ দিতে চেয়েছেন, তা সুস্পষ্ট নয়। এসব নিয়ে আমি ভাবিত হয়েছি।
এ সময় বন্ধুদের সঙ্গে ভার্চুয়াল অড্ডায়ও অনেক সময় কাটিয়েছি। মেসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোতে কথা বলে সময় কাটিয়েয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কথা বলার একপর্যায়ে আমার কতিপয় ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি আমার নিজের ডিসিপ্লিনে কোনো বই লিখছি কি না; অথবা কোনো গবেষণা প্রবন্ধ বা অন্যকিছু লিখছি কি না। আমি জবাব দিয়েছি, সব সময় সিরিয়াস গবেষণা ভালো লাগে না। হালকা কিছু লেখার চেষ্টা করছি।
যেমন কবিতা, অনুগল্প। কয়েকজন বন্ধু এ সময় আমাকে নাটক লিখতে অনুরোধ করেন। আমি শুনে অবাক হই। তাদের বলি, দেখ, এটি আমার লাইন নয় জেনেও তোমরা এমন অনুরোধ করছ কেন? তারা বলে, হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন, মারা গেছেন সেলিম আল দীন। তারা ভালো লিখতেন। এখনকার অভিনয়শিল্পীরা ভালো হলেও অধিকাংশ স্ক্রিপ্ট দুর্বল। তোমার লেখার হাত আছে। তুমি নাটক লেখো।
আমি তাদের কথায় রাজি না হলেও পরে বিষয়টি নিয়ে ভাবি। একপর্যায়ে চিন্তা করি, ঘরে বসে তো অলস সময় কাটাচ্ছি। একবার চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নেই। সে কারণে আমি ২০২০ সালে অনেক নাটক দেখি। সেসব নিয়ে ভাবি। তারপর ওই বছর আমি তিনটি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখি। প্রথম স্ক্রিপ্টটি থিম এবং মেসেজসমৃদ্ধ একটি লাভস্টোরি। এটি লেখার পর আমি মঞ্চনাট্য সমালোচক আমার এক ছাত্রকে দেখার জন্য পাঠাই। তাকে বলি, বাবা তুমি তো জানো আমি নাট্যকার নই। এটি প্রথম চেষ্টা।
তুমি যদি এর ভুলত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে দাও, তাহলে আমি আবারও লিখতে পারব। সে বলে, স্যার, আপনি আগে আমাকে পাঠান। আমি দেখব। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন পরই সে আমাকে ফিডব্যাক দেয়। বলে, স্যার এত ভালো মেসেজসমৃদ্ধ একটি ক্লাসিক প্রেমের নাটক এ বৃদ্ধ বয়সে আপনি কী করে লিখলেন, ভেবে অবাক হচ্ছি।
আমি জানতে চাইলাম, নাটকটি কি তোমার ভালো লেগেছে? সে বলল, খুবই ভালো লেগেছে। আপনার থিম ও ডায়ালগ অসাধারণ হয়েছে। আপনি এ বয়সে এ নাটক লিখতে পারলেন? আমি তাকে বললাম, দেখ, শিশুসাহিত্য কি শিশুরা রচনা করেন? আমার এ যুক্তি শুনে সে কথা বাড়াল না।
প্রথমে সে এবং তার বন্ধু, যারা ইউটিউবে শর্টফিল্ম করে, তারা মিলে নাটকটি করবে ভেবেছিল। পরে নানা কারণে তারা তা পারেনি। পরে নাটকটি আমি একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সভাপতিকে পড়ার জন্য পাঠাই। কিছুদিন হলো ভারত থেকে এ লাইনে ডিগ্রি করে ফিরেছেন। ব্যস্ত ব্যক্তিত্ব। তবে আমার অনুরোধে সময় নিলেও নাটকটি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।
বললেন, স্যার, চাইলে নাটকটি দু-এক জায়গায় বাড়ানোর সুযোগ আছে। আমি বললাম, আমি ফুটপাত থেকে অনেক মিষ্টি কিনে না খেয়ে দামি ও ভালো দোকানের এক পিস কাঁচাগোল্লা খেতে পছন্দ করি। আমি এটি বাড়াতে চাই না। সে বলল, স্যার তাতে অসুবিধা নেই। আমি তাকে বললাম, আপনারা তো এ লাইনের লোক, পারলে নাটকটি চিত্রায়ণের জন্য কাউকে দিন না।
তিনি আমার অনুরোধ শুনে একজন নাট্যপরিচালককে নাটকটি দিলেন। যাকে দিলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ থেকে পাশ করা মধ্যবয়সি নাট্য পরিচালক। আমি ইউটিউব ঘেঁটে তার কাজ দেখলাম। মন্দ নয়। তার পরিচালিত দুটি কাজ আমার বেশ ভালো লাগে। তবে তার আরও কিছু সাধারণ মানের নাটক এনটিভি, আরটিভি, চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত হয়েছে। আমাকে তার ফোন নম্বরও দেওয়া হলো। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
তার কাছ থেকে আর কোনো সিদ্ধান্তই পাওয়া গেল না। আমি ফোন করলেও তিনি ধরেন না। আর চেয়ারম্যান সাহেবও বারবার ফোন করেও তার কাছ থেকে সাড়া পাননি। ছয় মাসের মধ্যে তিনি একটি জমা দেওয়া স্ক্রিপ্টের বিষয়ে কথা বলার সময় পেলেন না! আমাকে বলা হলো, এরা নাকি এমনই। আমার কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হলো। ভাবলাম, নাটক জমা দিয়ে হয়তো অপরাধ করেছি। পরে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
এক নাট্যবোদ্ধাকে এসব বলায় তিনি আমাকে বললেন, এ এলাকায় ডিসিপ্লিন নেই, কমিটমেন্ট নেই। এরা এমন। তবে দুটি প্রোডাকশন হাউজ কিছুটা কথাবার্তা রাখে। আনাড়ির মতো জিজ্ঞেস করলাম, তারা কারা? তিনি বললেন, একটি আবুল হায়াতের এবং একটি সালাহউদ্দিন লাভলুর প্রোডাকশন হাউজ। আমি থাকি চট্টগ্রাম ও খুলনায়। এক হিসাবে অন্ধকারে। এদের সঙ্গে তো আর আমার পরিচয় নেই।
প্রায় চার দশক শিক্ষকতা করেছি। ছাত্ররাই আমার ভরসা। আরেকটি নাটক দিলাম এমন এক অভিনেতা ছাত্রকে, যিনি দেড় শতাধিক নাটক-সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন। তিনি তিনজন পরিচালককে জমা দিয়ে ৬-৭ মাসেও কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারলেন না। তবে সরাসরি ছাত্র হওয়ায় কয়েকবার ‘চেষ্টা করছি’ বলে আমার মেসেজের জবাব দিয়েছে।
কিন্তু এর মধ্যে ৬-৭ মাস পার হতে চলেছে। প্রশ্ন হলো, আমি নাটক জমা দিলাম, নাট্যকার যদি বলেন, এটি আমি করব না, এর মধ্যে তো দোষের কিছু নেই। কিন্তু তিনি যদি এক বছরেও বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও কিছু না বলেন; যদি ফোন না ধরেন, এটা কোন ধরনের ভদ্রতা!
আমার খুবই জানতে ইচ্ছা করে, ২০০২ সাল থেকে কাজ করা টিভি নাটক পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের কাজ কী? নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে বলছি-জানি না, এসব কর্মকাণ্ড এ প্রতিষ্ঠানটির কাজের আওতায় পড়ে কি না। অথবা এ প্রতিষ্ঠানটির এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কাজ করতে অসুবিধা আছে কি না। ২০১৬ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে এ সংগঠনটির কমিটি নির্বাচিত হয়ে আসছে।
এই তো গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ডিরেক্টরস গিল্ডের ২০২১-২২ মেয়াদের নির্বাচন সম্পন্ন হলো। ১২টি পদের জন্য লড়লেন ৩৪ জন প্রার্থী। জনপ্রিয় নাট্যব্যক্তিত্ব সালাহউদ্দিন লাভলু অনন্ত হীরাকে ২১ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক পদে মাত্র ৯ ভোটের ব্যবধানে জিতলেন কামরুজ্জামান সাগর। সহসভাপতি পদে মাসুম আজিজ (২৬৮), ফরিদুল হাসান (১৯৯) এবং রফিকুল্লাহ সেলিম (১৬৯) নির্বাচিত হলেন। সারা বছর এরা কী করেন? আমার চোখে তো এদের উল্লেখযোগ্য কাজ চোখে পড়ে না। এদের কাউকেই আমি না চিনলেও বুঝি যে, এরা সবাই যোগ্য এবং সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। পরপর দুবার নির্বাচিত সালাহউদ্দিন লাভলু সর্বমহলে পরিচিত।
তার পরিচালিত কিছু ভালো কাজও আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। অন্য সবাইও প্রথিতযশা। এরা কি চাইলে নাট্যজগতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কাজটি করতে পারেন না? অন্তত সংশ্লিষ্টরা কি এমন একটি নিয়ম করতে পারেন না যে, একজন চিত্রনাট্যকার যদি কোনো পরিচালকের কাছে কোনো স্ক্রিপ্ট জমা দেন, তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে হবে।
তার চিত্রনাট্য বিষয়ে সাড়া না দিয়ে তা মাসের পর মাস বা বছরাধিককাল ফেলে রাখা যাবে না। আমি একজন শিক্ষক হিসাবে একটু দেরিতে হলেও নবনিযুক্ত ডিরেক্টরস গিল্ডের নির্বাচিত কমিটিকে স্বাগত জানাই। চার দশক ধরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও আপনাদের লাইনে তো আমি আনাড়ি। আমার বক্তব্যে ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন। সবশেষে আমি আপনাদের নতুন কমিটির সাফল্য কামনা করি। সেই সঙ্গে আমি আপনাদের বিনীতভাবে নাট্যজগতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে অনুরোধ করি। আপনাদের না বললে আর কাকে বলব? প্লিজ, রাগ করবেন না।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com