বারবেলের ওজন ২৫ কেজি, অ্যাঙ্কেলের ওয়েটের ওজন দুই-দুই মিলিয়ে চার কেজি। দলীয় অনুশীলন ও বিশ্রামের বাইরে এই ২৯ কেজি ওজন নিয়েই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে ৩২ বছর বয়সী আরিফুল ইসলামের। এর বাইরে স্ত্রী আসমা ইসলাম বর্ষা ও ১১ মাস বয়সী ছেলেকে নিয়েই তাঁর জীবন।
আরে এ কী কাণ্ড!
শোয়া অবস্থায় বাঁ পা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলেও ডান পা মাথার কাছে সটান করে রাখা। হঠাৎ কেউ দেখলে শুধু চমকেই উঠবেন না, পেতে পারেন ভয়ও। তাঁর দিন-ই শুরু হয় এভাবে বিছানায় পা ছড়িয়ে দিয়ে স্ট্রেচিং করে। এরপর বিছানার কাছে থাকা বোতল মুখে পুরে দিয়ে ঢক...ঢক...।
ফুটবলার আরিফুল ইসলাম, দেশের ফুটবলারদের মধ্যে এই ডিফেন্ডারের প্রতিদিনের গল্পটা অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, তাঁর কাজকর্মের জন্য সতীর্থদের কাছ থেকে জুটে গেছে আদুরে পরিচয় ‘জিম ম্যান’। কেউ কেউ ‘সিরিয়াস আরিফ’ নামেও করেন সম্বোধন।
দেশের ফুটবলারদের বিপক্ষে মোটা দাগের একটা অভিযোগ আছে, তাঁরা মোটেও পেশাদার নন। নিজের ভবিষ্যতের কথাও ভাবেন না। এই অভিযোগগুলো অন্তত আরিফের সঙ্গে খাটবে না। তাঁর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে লেখা থাকে একটি আপ্তবাক্য, ‘নিজেকে ফিট রাখো।’ ফিট থাকার জন্য কিনা করেন আপাতত জাতীয় দলে সাবেক হয়ে যাওয়া আরিফ? ভোর থেকে তাঁর সঙ্গে থাকলে অবাক হয়ে যেতে হয়।
শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের জার্সিতে খেলছেন আরিফ। বড় ফ্ল্যাটের কয়েকটি রুমের মধ্যে থেকে তাঁর রুমটা চিনে নেওয়া যায় অনায়াসেই। কারণ, রুমের বাইরে আছে ব্যক্তিগত অনুশীলনের জন্য সাইক্লিং মেশিন, ওয়েট ট্রেনিংয়ের জন্য বারবেল, অ্যাঙ্কেল ওয়েট, ব্যালেন্স বোর্ড, রোলারসহ বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। আরও একটা বিশেষ দিক, তাকে তাকে সাজানো দামি ব্র্যান্ডের বুট। এ দুটি বিষয় মিলে গেলেই রুমটি আরিফের।
রুমে তো প্রবেশ করলেন। তিনজনের রুমে কীভাবে চিনবেন আরিফের বিছানা? দেখুন, কোনো বিছানার পাশে স্তূপ হয়ে আছে বাহারি পদের খাবার। কলা তো খুবই স্বাভাবিক। মধু, রুটি, কিশমিশ, খেজুর, কাজুবাদাম, বেদানা, আঙুর ও বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বড় বড় প্রোটিনের জার আছে? তাহলেই আরিফের বিছানা ভেবে নিশ্চিত হয়ে বসে পড়তে পারেন। এবার শুরু হোক আরিফের দিনের রুটিনের পর্যালোচনা।
বারবেলের ওজন ২৫ কেজি, অ্যাঙ্কেল ওয়েটের ওজন দুই-দুই মিলিয়ে চার কেজি। দলীয় অনুশীলন ও বিশ্রামের বাইরে এই ২৯ কেজি ওজন নিয়েই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে আরিফের। যখনই একটু বিরতি, ব্যাস ২৫ কেজি বারবেল নিয়ে এই একটু স্কোয়াড মেরে নিচ্ছেন। রাবার (টিউব) আর অ্যাঙ্কেল ওয়েট তো দিনের বেশির ভাগ সময় বিছানার ওপরেই থাকে। মাঠে যাওয়ার সময় সঙ্গেও নিয়ে যাওয়া হয়। অনুশীলন বা ম্যাচে তাঁর ওয়ার্মআপ শুরু হয় টিউব ও অ্যাঙ্কেল ওয়েট দিয়েই। যেখানেই যান, সঙ্গে নিয়ে যান যন্ত্রগুলোও। মোদ্দা কথা, ফিট থেকে মাঠে নামার জন্য আরিফের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। এর ফাঁকে ফাঁকে কিশমিশ, বাদাম, মিনারেল পানি, প্রোটিন খেয়েই যাচ্ছেন। এমনি এমনি তো আর তাঁর নাম ‘জিম ম্যান’বা ‘সিরিয়াস আরিফ’ হয়নি।
বছরে ফিট থাকার বাড়তি খাবারের পেছনে কত টাকা খরচ করেন, শুনলে চমকে উঠতে হয়। প্রায় তিন লাখ টাকা। ২০১২ সালে শেখ জামালে যোগ দেওয়ার পর থেকেই চলছে তাঁর এই খাবার রুটিন। মৌসুমে বুট ক্রয় করেন প্রায় দুই লাখ টাকার, ‘ফুটবল খেলেই তো টাকা পাই। আর ভালো খেলার জন্য আমাকে পরিশ্রম করে খাওয়াদাওয়া করে ফিট থাকতে হবে। আর খেলার জন্য বুটও থাকা চাই ভালো। এর জন্য টাকা তো খরচ করতেই হবে।’
চলতি মাসেই শুরু হওয়ার কথা রয়েছে প্রিমিয়ার লিগ। এবার কমপক্ষে খেলা হওয়ার কথা রয়েছে সাতটি ভেন্যুতে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দৌড়াতে আরিফের প্রাত্যহিক জীবনের কী ছন্দপতন ঘটবে না! ২৫ কেজি ওজনের বারবেলের বিকল্প ব্যবস্থা হয়ে গেছে, ‘যেহেতু ওয়েট ট্রেনিং ছাড়া আমার চলবে না। আমি প্রায় সব ভেন্যুতেই এবার খবর নিয়ে রেখেছি স্থানীয় জিমগুলোর ব্যাপারে। শুধু অ্যাঙ্কেল ওয়েট, টিউব আর খাবার সঙ্গে নিয়ে যাব।’
ঠান্ডা মাথার সেন্টারব্যাক হিসেবে জুড়ি নেই আরিফের। অনূর্ধ্ব–২০ ও ২৩ দল হয়ে জাতীয় দলে কয়েক বছর আগেও নিয়মিত মুখ ছিলেন আরিফ। ২০০৬ সালে কাতারের বিপক্ষে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব দিয়ে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তাঁর। ২০১৫ সালে শেষ খেলেছেন তাজিকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ। ১১ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে জিতেছেন ২০১০ সালের এস এ গেমসের শিরোপা। কিছুদিন তো জাতীয় দলের অধিনায়কত্বও করেছেন। এ ছাড়া আবাহনী লিমিটেড ও শেখ জামালের হয়ে বেশ কয়েকটি শিরোপা জেতার অভিজ্ঞতাও রয়েছে। কিন্তু দেশের ফুটবলে আরিফের যেভাবে সৌরভ ছড়িয়ে আগমন, সেই ধারাটা ধরে রাখতে পারেননি, ‘আমি নিজেও মানি, সবাই আমাকে দিয়ে যেভাবে আশা করেছিল, সেভাবে আমি খেলতে পারিনি।’
এর পেছনে চোটকেই দায়ী করলেন বরিশালের ছেলে আরিফ। তিনটি অপারেশন হয়েছে দুই পায়ে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই মোহামেডানে খেলা অবস্থায় ডান পায়ের কুঁচকিতে চোট। ২০১২ সালে শেখ জামালে ডান পায়ের হাঁটু আর ২০১৪ সালে অপারেশন হয় বাঁ পায়ের হাঁটুতে। এ কারণেই ছয় বছর ধরে নিয়ম করে চলা। তাঁর আফসোস, শুরু থেকেই যদি ওয়েট ট্রেনিং ও খাবারের বিষয়ে সচেতন থাকা যেত, তাহলে অন্তত চোট এড়ানো যেত কিছুটা। কিন্তু এটাও ঠিক ক্যারিয়ারের শুরুতে টাকা না থাকায় বিষয়গুলো মেনে চলাও কঠিন ছিল।
তরুণ ফুটবলাররা আরিফের গল্পটা শুনলে ভালো। বর্তমান সময়ে তরুণ ফুটবলারদের হাতে শুরুতেই অনেক টাকা। আরিফের মতো নিয়ম করে অনুশীলন ও খাবারে যত্নশীল হওয়ার ব্যাপারটা তাঁরাও মাথায় রাখতে পারেন।