ঋণের টাকা বিদেশে পাচারসহ ব্যাংক খাতে নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের নজিরবিহীন জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত গ্রুপটির ২১ হাজার কোটি টাকার ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে খেলাপি ১১ হাজার কোটি টাকা। ২৭টি ব্যাংক ও ১টি ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে এসব ঋণ নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় সব নির্দেশ উপেক্ষা করা হয়েছে। কার্যত ঋণের নামে ব্যাংকগুলোতে লুটপাট চালানো হয়েছে। ঋণের টাকাই পাচার করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে এবং হুন্ডির মাধ্যমেও পাচার করা হয়েছে অর্থ। পাচারের টাকা চার দেশে ১৮টি সেল কোম্পানিতে (মালিকানা গোপন করে বেনামি কোম্পানি) বিনিয়োগ করা হয়েছে। বিদেশে হাউজিং, গার্মেন্ট ও ট্রেডিং ব্যবসা আছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কেনসিংটনে বিলাসবহুল দুটি বাড়ি কেনা হয়। এখন পর্যন্ত বিদেশে তার প্রায় ৬৭০ কোটি টাকার সম্পদ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সব মিলে ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আটক করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

নাসা গ্রুপের জাল-জালিয়াতি উদঘাটন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), সিআইডি তদন্ত করছে। ইতোমধ্যে ওই সব সংস্থার তদন্তের ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন পাচার টাকা উদ্ধারের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিএফআইইউ নাসা গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৪৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। বেআইনিভাবে ৭৮১ কোটি ৩১ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি গ্রুপটি। ফলে এগুলোর বিষয়ে তদন্ত চলছে। এছাড়া গ্রুপের স্বনামে আরও কিছু ব্যাংক হিসাবে ৫২১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, দেশের ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে ৩ হাজার ৮১ ডলার বা ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা ও ৬ হাজার ৬৪০ পাউন্ড বা ১০ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, নাসা গ্রুপের যুক্তরাজ্য, হংকং, আইল অব ম্যান ও জার্সিতে বিপুল সম্পদ ও বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে ওইসব দেশে মোট ১৮টি শেল কোম্পানি শনাক্ত করা হয়েছে। এসব কোম্পানির মাধ্যমে আমদানি, রপ্তানি, হাউজিং ও ট্রেডিং ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। কোম্পানিগুলোতে স্থানীয় উৎস থেকে বিনিয়োগের জোগান দেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা দেশ থেকে পাচার করা টাকা দিয়েই ওইসব কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য, আইল অব ম্যান ও জার্সিতে ৩ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড বা ৬৪৪ কোটি টাকার ৭টি সম্পত্তি চিহ্নিত করা হয়েছে। বিদেশি একটি ব্যাংকের হিসাবে ২ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ডের বা ৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকার স্থিতি পাওয়া গেছে। ব্যাংক হিসাবে থাকা অর্থের লেনদেন স্থগিত করতে সংশ্লিষ্ট দেশের মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। এসব মিলে এখন পর্যন্ত বিদেশে প্রায় ৬৭০ কোটি টাকার সম্পদ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সব মিলে নাসা গ্রুপের ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আটক করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কেনসিংটনে বিলাসবহুল দুটি বাড়ি কেনেন নজরুল ইসলাম। ওই বাড়ি কেনা বাবদ ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড তিনি সরাসরি পরিশোধ করেছিলেন। রপ্তানি আয় দেশে না এনে ওইসব অর্থ বিদেশে নগদায়ন করে তিনি ওই লেনদেন করেছিলেন বলে জানা গেছে। এছাড়া লন্ডনে বেনামে নাসা গ্রুপের নামে হাউজিং ব্যবসা পরিচালনার তথ্যও পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, টাকা পাচার ছাড়াও ব্যাংক খাতে নাসা গ্রুপ নজিরবিহীন জালিয়াতি করেছে। স্বনামে ঋণ নেওয়ার চেয়ে বেনামি কোম্পানি ও হিসাব খুলে তিনি সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নাসা গ্রুপের নামে মোট ঋণের স্থিতি ছিল ৮৭২২ কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত শুরু করলে গ্রুপের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৫০ কোটি টাকা। পরে এর পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার কোটি টাকায়। সমন্বিত তদন্ত শুরু হলে ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কারণ সমন্বিত তদন্তের মাধ্যমে ১৯টি কোম্পানিকে শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলোর সঙ্গে নাসা গ্রুপের সরাসরি কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু এসব গ্রুপের নামে নেওয়া ঋণ, প্রণোদনা সুবিধা ও অন্যান্য কার্যক্রমের মূল সুবিধাভোগী ছিল নাসা গ্রুপ। এভাবে নাসা গ্রুপের ১৯টি বেনামি কোম্পানিকে শনাক্ত করা হয়। যেসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব নেই। এগুলোর মাধ্যমে গ্রুপটি প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী কোম্পানির অস্তিত্ব ও গ্রাহকের পরিচিতি নিশ্চিত হয়েই ব্যাংক হিসাব খুলবে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাংক কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেনি। তারা নজরুল ইসলামের বেআইনি প্রভাবের কারণে নাসা গ্রুপকে পানির মতো ঋণ দিয়েছে। ঋণের অর্থ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে স্থানান্তর হওয়ার কথা থাকলেও মোটা অঙ্কের অর্থ নগদ আকারে বেআইনিভাবে ব্যাংক থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। ওইসব অর্থে বাজার থেকে ডলার কিনে সেগুলো হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

২০২২ সালে বৈশ্বিক মন্দার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসিতে ডলারের জোগানে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করলে এবং ফল আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলেও নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন মাদিনা ট্রেডিংয়ের ফল আমদানিতে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি।

জনতা ব্যাংকের পর্ষদ নাসা গ্রুপের ২৬১ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দিলে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জনতা ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়। ব্যাংককে যাতে কোনো ব্যাখ্যা দিতে না হয় সেজন্য নজরুল ইসলাম মজুমদার তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে গিয়ে তদবির করেছিলেন। ফলে চাপের মুখে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা যায়, নাসা গ্রুপের রপ্তানি আয়ের অর্থ যেমন দেশে আসেনি, তেমনি আমদানির দায় পরিশোধ করা হলেও পণ্যও দেশে আসেনি। ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি করা হলেও তার বিপরীতে কোনো পণ্য রপ্তানি করা হয়নি। ফলে এলসির দায় ব্যাংক ফোর্সলোন সৃষ্টি করে পরিশোধ করেছে। নাসা গ্রুপের মোট ঋণের মধ্যে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা রয়েছে ফোর্সলোন।

নাসা গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো কোনো নিয়ম-কানুন মানেনি। সীমার চেয়ে বেশি ঋণ দিতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদন ছাড়াই নয়টি ব্যাংক নাসা গ্রুপকে সীমার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। ঋণের বিপরীতে নাসা গ্রুপ যথেষ্ট জানামত যেমন দেয়নি, তেমনি দেয়নি করপোরেট গ্যারান্টিও। এছাড়া ঋণের বড় বড় অংশ বেনামি হওয়ায় এর বিপরীতে ব্যাংকও কোনো গ্যারান্টি নেয়নি।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৫ সাল পর্যন্ত নাসা গ্রুপের মোট ঋণের স্থিতি ছিল ৩৭০০ কোটি টাকা। তবে গ্রুপের নামে বেনামি ঋণ আগে থেকেই ছিল। ২০১৬ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলের পর থেকে তাদের ঋণ বাড়তে থাকে। ওই সময়ে তিনি ইসলামী ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন। পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংক থেকেও নিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ২৭টি ব্যাংক ও ১টি ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে তার ঋণ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। নাসা গ্রুপের বেনামি কোম্পানি নামের ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। কারণ এখনো সব বেনামি কোম্পানিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

রপ্তানিকারকরা মোট রপ্তানি আয়ের একটি অংশ রিটেনশন কোটা সুবিধা পান। এ অর্থ তারা বিদেশে রাখতে পারেন। সেগুলো বিদেশে ব্যবসার উন্নয়নে খরচ করতে পারেন। এ খাতেও মাত্রাতিরিক্ত ডলার খরচ ও অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাসা গ্রুপের বাইরে নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যক্তিগত নামে থাকা আরও প্রায় ২০০ কোটি মূল্যের সম্পদ আটক করা হয়েছে। সেগুলোর বিষয়েও বিশদ তদন্ত চলছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews