‘হাসির রাজা, জ্ঞানের রাজা..., গোপাল ভাঁড়’। সাবেক দেশসেরা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ জ্ঞানের রাজা না হতে পারেন, নিজের পরিচিত গন্ডির মধ্যে ছিলেন কিন্তু হাসির রাজা। রসিকতায় তার জুড়ি মেলা ভার। বয়স হয়ে গেছে অনেকটাই। এখনও দারুণ রসিক মানুষ কায়সার হামিদ। শুধু তাই নয়, এখন তো সেলফি ‘রাজা’ নামেও অনেকে ডেকে থাকেন তাকে।

সাফ গেমস ফুটবলের ক্যাম্প চলছে জিরানীর বিকেএসপিতে। রেস্ট ডে’তে একটু ঘুমাচ্ছিলেন ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ। রুমমেট গোলরক্ষক ছাইদ হাছান কানন; কিন্তু একটু বেলা হতে দরজায় খটকখট শব্দ, ‘কাপড় আছে? কাপড়।’ চোখমুখ লাল করেই দরজার খুললেন কায়সার হামিদ। দরজায় দাঁড়ানো দু’জন বলছিলেন, ‘লন্ড্রিতে কাপড় দেয়ার আছে কি না।’

রাগ পানি করে কায়সার জানতে চাইলেন, ‘এগুলো করে দৈনিক কত টাকা আয় করো?’ ‘স্যার ২০ থেকে ৫০ টাকা।’ ‘তো ধোপাগিরী ছেড়ে আমাদের ম্যাসাজ কর। এর চেয়ে বেশি টাকা পাবি।’ ব্যাস, একজন কায়সারের আরেকজন কাননের শরীর ম্যাসাজ শুরু করলেন।

তখন বাংলাদেশ ফুটবল দলের কোচ ছিলেন সুইজারল্যান্ডের সোয়াব। একটু পর তিনি রুমে ঢুকে ওদের দেখেই হুঙ্কার ‘হু আর দে?’ কায়সার কোচকে বোঝালেন ওরা, ‘লোকাল ম্যাসাজম্যান।’ সোয়াব মানবেন না। বললেন, ‘ওরা যেভাবে ম্যাসাজ করছে তা সঠিক নয়। আমি ওদের শিখিয়ে আনি।’

ব্যাস কোচ সোয়াব নিচে নামিয়ে নিয়ে গেলেন ওই দুই লন্ড্রিম্যানকে। দুইজনকে কয়েক ঘণ্টা ট্রেনিং দিয়ে আবার কোচ তাদের নিয়ে আসলেন কায়সার-কাননের রুমে। বললেন, ‘এখন ওদের দিয়ে ম্যাসাজ করাতে পারবে।’ ওইদিন থেকে দুই লন্ড্রিম্যান হয়ে গেলেন জাতীয় ফুটবল দলের ম্যাসাজম্যান।

‘আমি অনেক দুষ্টুমি করেছি; কিন্তু এই দুষ্টুমির মধ্যে দিয়ে অনেকের অনেক উপকারও করেছি। জাতীয় দলের ক্যাম্প শেষ হওয়ার পর ওই দুইজনের একজন মোহামেডানে, আরেকজন মুক্তিযোদ্ধায় ম্যাসাজম্যান হিসেবে চাকুরি করেছেন। এই তো বছরখানেক আগে তাদের একজনের সঙ্গে দেখা। দাঁড়িওয়ালা হঠাৎ একজন আমাকে সালাম দিয়ে পরিচয় দিলেন। আমি প্রথমে চিনি নাই। বললো, ‘স্যার, আমি ম্যাসাজম্যানের চাকরি করেই রাজাধানীর গোড়ানে দুই কাঠা জমি কিনেছি। নিজের বাড়িতেই থাকি।’

শুনে আমার খুব ভালো লাগছিল যে, আমি চুষ্টুমি করে যাদের ধোপার কাজ থেকে সরিয়ে ম্যাসাজম্যান করেছিলাম তাদের একজনের ঢাকায় নিজের বাড়ি আছে’- ৩৫ বছর আগের গল্প বলছিলেন দেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ।

কয়েকদিন আগে সাবেক ফিফা রেফারি আবদুল আজীজ তার গল্পের ভুঁড়িটা খুলেছিলেন। এবার নিজের রসিকতা আর গল্পের ঝুড়ি খুললেন ফুটবলার কায়সার হামিদ। তিনি মাঠেই কেবল অতন্দ্রপ্রহরী ছিলেন না, মাঠ ও মাঠের বাইরে দুষ্টুমিতেও ছিলেন রাজা।

তার এই দুষ্টুমি নিয়ে আছে শতশত গল্প। বলেন না আরো কয়েকটা। কায়সার হামিদ বলেন, ‘কোনটা রেখে যে কোনটা বলি? আমার গল্পগুলো ভালো করে বলতে পারে টিটু (আরেক তারকা ফুটবলার সাইফুল বারী টিটু)। সে এখনো মাঝেমধ্যে একসাথে হলে বলে।’

কল্যাণপুরের পরিবর্তে ফরিদপুরে

‘একদিন সন্ধ্যায় ম্যাচ শেষ করে আটরশি (ফরিদপুর) যাওয়ার প্ল্যান করলাম। তিনজন রওয়ানা দেবো ক্লাব থেকে। সাথে ছাইদ হাছান কানন ও ওই সময়ের সহকারী ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম বাবু। এমন সময় একজন সমর্থক ক্লাবের গেটে বললেন, আপনারা কোথায় যাবেন? বললাম ফরিদপুর। সে বললো তাহলে আমাকে একটু নিয়ে যান কল্যাণপুর নামিয়ে দিয়েন। আমি বললাম, ঠিক আছে। কখন নামবি আওয়াজ দিস।

Kaysar Hamid

তখন রাস্তা তো ফাঁকা। তাও আবার রাতের বেলা। গাড়ি চালিয়ে কল্যাণপুর, গাবতলী, সাভার ছাড়িয়ে মানিকগঞ্জের একটি প্রেট্রোলপাম্পে থামার পর পেছন থেকে সমর্থক বললেন, ‘স্যার আমাকে তো নামালেন না।’ তো আওয়াজ দিবি না? সে বললো, অনেক আওয়াজ দিয়েছি, গাড়ীতে থাপ্পড়ও দিয়েছি। আপনি থামাননি। বলললাম, ‘এখানে নেমে তো আরো ঝামেলায় পড়বি। চল আটরশি থেকে ঘুরে আসি। সকালে যাওয়ার পথে তোকে নামিয়ে দেবো। ফেরার পথে পরের দিন তাকে কল্যাণপুর নামিয়েছি। এমন অনেক ঘটনা আছে। আরিচা ফেরিঘাট থেকে অনেককে এভাবে নিয়ে আসতাম। আবার কাউকে কাউকে চাকরিও দিয়েছি।’

উই হ্যাভ টিকিট, উই নিড ভিসা

‘১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপ ফুটবল। অনেকে বাফুফে থেকে টিকিট কিনেছে; কিন্তু সবার ভিসা মিলছিল না। মোহামেডানের কয়েকজন সমর্থকসহ এ রকম ১৮ জন ভিসা না পেয়ে একদিন ক্লাবে এলেন। ওদের কাছে শুনলাম ইতালি অ্যাম্বাসি কিছুতেই ভিসা দেবে না। সব শুনে ওদেরকে কাগজে লিখে দিলাম, ‘উই হ্যাভ টিকিট, উই নিড ভিসা।’

বললাম- কাল সকালে অ্যাম্বাসিতে গিয়ে এটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবি। ওরা গেলো। কিছুটা কাজ হলো। অ্যাম্বাসি থেকে বলা হলো, তোমাদের লিডার কে তাকে নিয়ে কাল সকাল ১০ টায় আসবা। ওরা আমাকে এস বললো, এ কথা। আমি ওদের নিয়ে গেলাম পরের দিন। কারণ, ওরা কেউ ইংরেজি জানে না। অ্যাম্বাসি থেকে বলা হলো- এটাতো ভিসা চাওয়ার সিস্টেম না। ওদের ব্যাংক বিররণী যথাযথ নেই। আমি বললাম, এটা তো তোমরা আগে বলোনি যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট লাগবে। তাহলে তো ওরা টিকিট কিনতো না।

তারপর বললো ঠিক আছে ওদের, ‘নোতোবারবেলে’ লাগবে। কি বলে নোতোবারবালে? পরে বুঝলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নোট ভারবাল আনতে হবে। কি আর করার গেলাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সঙ্গে নিয়ে গেলাম বায়জীদ নামে আমার এক বন্ধুকে। সে আবার ছিল সাব্বিরের (ফুটবলার সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির) মতো দেখতে। সচিবের কাছে খবর গেলো ফুটবলার কায়সান হামিদ আর সাব্বির এসেছেন দেখা করতে। তখন তো আমাদের আলাদা একটা ক্রেজ ছিল। কায়সার-সাব্বিরের কথা শুনে সচিব ভেতরে ডাকলেন। বললাম- আমি কায়সার ও সাব্বির। সচিব আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের ভালো করেই চিনি। বায়জীদকে সাব্বির বানিয়ে কাজ সেরে আসলাম।’

Kayser Hamid

‘এমন আরো কয়েক জায়গায় ওই বায়েজীদকে পুরস্কারমঞ্চে উঠিয়েছি সাব্বির সাজিয়ে। মাইকে ঘোষণা হলো- এখন পুরস্কার নিতে আসছেন দেশের আরেক কৃতি ফুটবলার সাব্বির। কিন্তু সাব্বির অনুপস্থিত। মঞ্চে গিয়ে পুরস্কার নিয়ে আসতেন বায়েজীদ। কেউ বুঝতেই পারলেন না কার পুরস্কার কে গ্রহণ করলেন।’

ছবি তুলতে গিয়ে চাল ভেঙ্গে পড়লেন থাই নারীদের ওপর

ঘটনা থাইল্যান্ডে খেলতে যাওয়ার পর। ফাইভস্টার হোটেলে থাকছি আমরা। হোটেলের জানালা খুলে দেখি সুন্দর ভিউ। ছবি তোলার ইচ্ছা হলো। জানলার একটু নিচে একটা ফাইবারের চাল। মনে হচ্ছিল বেশ শক্তপোক্ত। ছাইদ হাছান কানন বললো ওখানে নেমে দাঁড়া দারুণ ছবি হবে। জানালা দিয়ে ওখানে নামার পরই গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেলো সব। চুরমুর করে ভেঙ্গে পরে গেলাম একদম নিচে। যেখানে থালাবাসুন ধোয়ার কাজ করছিল কিছু থাই নারী। ব্যাস, ওদের একজনের ঘাড়ের ওপর পড়লাম। শুরু হলো ছোটাছুটি, চিল্লাচিল্লি। সবাই হয়তো ভেবেছিল ভূমিকম্প হয়েছে বা অন্য কোনো বড় বিপদ। নিরাপত্তাকর্মীরা ছুটে এলো। পরে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো সবাই।’

পিস্তলের গুলি থেকে অল্পের জন্য রক্ষা মোহামেডানের কোচ
ক্লাবে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। একজন সাংবাদিক এলেন সাক্ষাৎকার নিতে। তখন আমার হাতে লাইসেন্স করা পিস্তল। সাংবাদিক বললেন- পিস্তল আসল নাকি নকল? আমি মুখে কিছু বললাম না। চালে করলাম গুলি। বাইরে লনে বসা ছিলেন কোচ কায়কোবাদ ভাই। তার পেট ঘেঁষে চলে গেলো। হালকা রক্ত বের হলো। সবাই দৌঁড়ে এসে আমাকে বললো, কোচকে গুলি করেছি কি না। পরে বোঝালাম। এ রকম আরো কয়েকটি ঘটনার পর হুটহাট ফাঁকা গুলি করা বন্ধ করে দেই।

একবার তো একটি মূর্তিকে গুলি করলে সেটা আমার দিকেই এসে হাতের পাশ দিয়ে চলে যায়। ওটা ছিল শিল্পী মৃণাল হকের উত্তরার বাসায়। একটা মূর্তি দেখে ভাবলাম করি একটা গুলি। গুলি করতেই সেটা দেয়ালে লেগে আবার আমার হাতের কাছ দিয়ে চলে যায়। এরপর বাবাও আমাকে এভাবে ফাঁকা গুলি ছুড়তে নিষেধ করে দেন।

গুলি নিয়ে আরো ঘটনা আছে আমার। একবার ময়মনসিংহ থেকে ফিরছিলাম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে খুলনাকে ২-০ গোলে হারিয়ে। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের। কঠিন ম্যাচ ছিল। আমার দুই হাঁটু ছিলে গিয়েছিল। গাড়ী চালানোর অবস্থায় ছিলাম না। কাননকে বললাম তুই চালা।

টঙ্গীতে আসার পর সামনে একটা বাস কিছুতেই সাইড দিচ্ছিল না। এভাবে উত্তরার ব্রিজ অতিক্রমের পর সাইড দেয় এবং সামনে গিয়ে কাননকে বললাম গাড়ী থামা। তারপর বাসের হেলপার আসলো অনেকটা রংবাজের মতো। বললো এটা এক সার্জনের বাস। আমি বললাম সাইড দিলি না ক্যান। বাসের হেলপার বললো ক্যামনে সাইড দিমু। আমি করলাম ফাঁকা গুলি। ব্যাস, দিলো ভোঁ দৌড়। এগিয়ে দেখি ড্রাইভারও দৌড়ে পালিয়েছে। তিনদিন পর ওই বাসের মালিক সার্জন ক্লাবে এসে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে যান।

Kayser Hamid

রসিকতা ও দুষ্টুমি নিয়ে এ রকম শতশত গল্প আছে কায়সার হামিদের। দেশের অন্যতম সেরা এ স্টপার মোহামেডানের কায়সার হিসেবেই বেশি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তারপরও সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক।

সাদা-কালো ক্লাবটির জার্সিতে খেলেছেন ১৯৮৫ সাল থকে ১৯৯৬ পর্যন্ত। এর আগে খেলেছেন রহমতগঞ্জ ও বিজেএমসিতে। জাতীয় দলের খেলেছেন ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। তার অধিনায়কত্বেই বাংলাদেশ (লাল দল) প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে। ৭টি সাফ গেমস এবং তিনটি বিশ্বকাপ বাছাই খেলেছেন কায়সার হামিদ।

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ও ১৯৯০ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কায়সার হামিদকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। তিনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৩ সালে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সেরা একাদশ নির্বাচন করেছিল। সে তালিকায় ছিলেন কায়সার হামিদ। ছিলেন ২০০৫ সালে বাফুফে কর্তৃক সম্মানিত ১০ জন ফুটবলারের মধ্যেও। তার অন্যতম পরিচয়, তিনি নারী দাবাড়ু রাণী হামিদের ছেলে।

আরআই/আইএইচএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews