ছবির উৎস, ANI
ছবির ক্যাপশান,
বাংলাদেশ সীমান্তে বেড়া বসাতে যে ধরনের কাঁটাতার ব্যবহার করে ভারত। প্রতীকী ছবি
Author,
শুভজ্যোতি ঘোষ
Role,
বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি
২৪ মিনিট আগে
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল, ভারতের আসামে বিভিন্ন দলের বেশ কিছু রাজনীতিবিদ দাবি তুলেছিলেন সে দেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে দেওয়াল বা বেড়া জাতীয় কিছু বসানো হোক।
তখন সেই দাবি দিনের আলো দেখেনি, কিন্তু ১৯৮৫তে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আর আসামের সিভিল সোসাইটি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে 'আসাম শান্তিচুক্তি' স্বাক্ষরিত হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ভারত সরকার পার্লামেন্টে ঘোষণা করে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সীমান্তের পুরোটা জুড়েই 'কাঁটাতারের বেড়া' বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতে তখন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকার, আর বাংলাদেশে চলছে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক শাসন।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে আসাম শান্তি চুক্তির যে একটা বড় ভূমিকা ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই – কারণ ওই চুক্তিতেই বলা হয়েছিল, "ভবিষ্যতের অনুপ্রবেশ রুখতে আন্তর্জাতিক সীমান্তে প্রাচীর, কাঁটাতারের বেড়া কিংবা অন্যান্য বাধা স্থাপন করে সেটিকে আরও সুরক্ষিত ও নিশ্ছিদ্র করে তোলা হবে।"
ততদিনে ভারতের পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তেও কাঁটাতার বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে – আর সেটা সীমান্তে অবৈধ পারাপার, চোরাচালানের মতো আপরাধ ও জঙ্গী কার্যকলাপ ঠেকাতে কাজে আসছে বলেও ভারত মনে করছে। পূর্ব সীমান্তেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পেছনে সেটাও ছিল একটা বড় কারণ।
বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর আসল কাজ শুরু হতে হতে অবশ্য আরও বছর তিনেক কেটে যায়। ১৯৮৯ সালে শুরু হয় বেড়া বসানোর প্রথম পর্যায়ের কাজ, আর তাতে মোট ৮৫৪ কিলোমিটারের মতো সীমান্তে কাঁটাতার লাগানো হয় – যা ছিল মোট সীমান্তের কুড়ি শতাংশের মতো।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
ত্রিপুরা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষে তৈরি 'বর্ডার রোড' ধরে টহল দিচ্ছে বিএসএফ
পরে ২০০০ সালে ভারত কাঁটাতারের বেড়া বসানোর দ্বিতীয় পর্যায় অনুমোদন করে, আর এই ধাপে আরও ২৪৩০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া বসানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়। তবে ৩১ জানুয়ারি ২০০৫ তারিখেও সেই টার্গেটের অর্ধেকই কেবল পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল।
বস্তুত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রায় চার দশক পরে এসেও ভারত সেই কাজ আজও পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি।
সুদীর্ঘ সীমান্তের মোটামুটি আশি শতাংশ অংশে এখনও পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়া বসানো সম্ভব হয়েছে – বাকি জায়গায় নানা কারণে কাজ আটকে গেছে। পাশাপাশি বেড়া বসানোকে ঘিরে দু'দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বিতর্ক, বিবাদ আর সংঘাতও কিন্তু কখনও থামেনি।
২০১১ সালের জারুয়ারিতে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছিল বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানি খাতুন – কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানির সেই ঝুলন্ত লাশের ছবি ভারতের বিরুদ্ধে সমগ্র বাংলাদেশের শোক, ক্ষোভ আর প্রতিবাদের প্রতীকেও পরিণত হয়েছিল।
এমন কী ভারতের অভ্যন্তরেও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানো নিয়ে তীব্র বিতর্ক ছিল, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি ছিল। সীমান্তবাসী মানুষজনের প্রতিক্রিয়াও ছিল মিশ্র।
বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর প্রস্তাবে শুরু থেকেই কখনও তেমন উৎসাহ দেখায়নি, আবার এর সক্রিয় বিরোধিতাও করেনি। এক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার শাসনামলে ঢাকার অবস্থান ছিল মোটামুটি একই রকম।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
শিলিগুড়ির কাছে ফাঁসিদেওয়া গ্রামে কাঁটাতারের বেড়া নেই, এমন একটি অংশে সাইকেলে পাহারা দিচ্ছে বিএসএফ
তবে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন, তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার সীমান্তের জিরো লাইন থেকে দেড়শো গজের মধ্যেও কোনও কোনও জায়গায় ভারতকে স্থাপনা বসানোর অনুমতি দেয় – যা ভারতের জন্য বেড়া লাগানোর কাজ সহজ করে তুলেছিল।
খুব সম্প্রতি সীমান্তের কোনও কোনও জায়গায় ভারতের নতুন করে বেড়া বসানোর চেষ্টাকে ঘিরে দু'দেশের বিরোধ আবার তুঙ্গে উঠেছে।
বর্ডারের দু'দিকের মানুষজন হাতিয়ার নিয়ে মারমুখী হয়ে উঠছেন, সীমান্তরক্ষীরা বাঙ্কার ও পরিখা খুঁড়ছেন – অন্য দিকে ঢাকা ও দিল্লিতে এই ইস্যুতে চলছে রাষ্ট্রদূতদের পাল্টাপাল্টি তলব।
এই পটভূমিতে বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের দেওয়া কাঁটাতারের বেড়ার ইতিহাস, ভূগোল, কূটনীতি আর সমাজতত্ত্বই ঘেঁটে দেখেছে এই প্রতিবেদন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের সীমান্তে যে সব প্রাচীর বা বেড়া দিয়েছে, তা নিয়ে বিশদে গবেষণা করেছেন মরক্কোর এসএমবিএ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সাঈদ সাদ্দিকি।
তার 'ওয়ার্ল্ড অব ওয়ালস' গ্রন্থে মি সাদ্দিকি লিখেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সব দেশের মতোই ভারতের ১৫ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি স্থল সীমান্তের বেশিটাই 'ম্যানমেড' বা মানুষের হাতে আঁকা – ফলে ওই সীমান্তগুলো মাটিতে এথনিক (জাতিগত) বা ভৌগোলিক বাস্তবতার সঠিক প্রতিফলন নয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
আরিজোনায় মেক্সিকো সীমান্তে আমেরিকার দেওয়া প্রাচীরের একটি অংশ
এই কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বারেবারে রাজনৈতিক বা ভূখন্ডগত বিরোধ তৈরি হয়েছে – আর সেখান থেকেই কাঁটাতারের বেড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে বলে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন।
তবে সাইদ সিদ্দিকি আরও বলছেন, ইসরায়েল পশ্চিম তীর বা গাজার সঙ্গে তাদের সীমানায় যে ধরনের 'ব্যারিয়ার' (প্রাচীর) দিয়েছে কিংবা মেক্সিকো সীমান্তের অনেক জায়গায় আমেরিকা যে রকম দেওয়াল তুলেছে তার সঙ্গে ভারতের এই কাঁটাতারের বেড়ার তুলনাই চলে না।
তিনি লিখছেন, "ভারতের এই বেড়া আসলে অনেক লো কস্ট ও লো টেকনোলজি-র" – অর্থাৎ খুব কম খরচে, অতি সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি।
এমন কী, মরক্কো থেকে অবৈধ অভিবাসন ও চোরাকারবার ঠেকাতে উত্তর আফ্রিকায় তাদের দুটো শহর সিউটা ও মেলিলা-তে স্পেন যে ধরনের বেড়া দিয়েছে, সেটাও ভারতের এই বেড়ার চেয়ে অনেক শক্তপোক্ত।
তবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বিবিসিকে বলছিলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে কংক্রিটের দেওয়াল তোলা সম্ভব নয় নানা কারণে – সে কারণে অনেক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরকারকে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
"কংক্রিটের দেওয়াল হলে আমাদের নজরদারি চালানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে, যাদের জমিজমা বেড়ার অন্য দিকে পড়েছে তাদের জন্য নিজেদের ক্ষেতে নজর রাখাও অসম্ভব হয়ে পড়বে", বলছিলেন ওই কর্মকর্তা।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
স্পেনের মেলিলা আর মরক্কোর মূল ভূখন্ডের মধ্যেকার দেওয়াল
সীমান্তে ভারতে যে ধরনের কাঁটাতারের বেড়া বসিয়ে থাকে, সেগুলো ভারতেরই বিভিন্ন কোম্পানি দেশি প্রযুক্তিতে দেশের ভেতরেই বানায়।
হরিয়ানার 'ইন্ডিয়া ফেন্সিং', গুজরাট-ভিত্তিক 'ভারত ফেন্সিং' বা নাগপুরের 'সুপার ওয়েল্ডমেশ' এরকমই কয়েকটি প্রথম সারির কাঁটাতারের বেড়া প্রস্তুতকারক সংস্থা।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭৫ সালে যে সীমান্ত সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়, তাতে বলা হয়েছিল সীমান্তরেখা বা জিরো লাইন থেকে দেড়শো গজের মধ্যে কোনও পক্ষই 'প্রতিরক্ষা সামর্থ্য' (ডিফেন্স পোটেনিশয়াল) আছে এমন কোনও স্থাপনা গড়তে পারবে না।
তা ছাড়া দেড়শো গজের মধ্যে কোনও 'উন্নয়নমূলক' (ডেভেলপমেন্টাল) স্থাপনা তৈরি করতে হলেও অপর পক্ষের কাছ থেকে সম্মতি নিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিতে শুরু করার পর দেখা গেল সীমান্তের অনেক জায়গাতেই দেড়শো গজের এই 'শর্ত' মানা সম্ভব হচ্ছে না। বা মানতে গেলে যেখানে বেড়া দিতে হবে, সেখানে তা দেওয়া অর্থহীন।
ভারত অবশ্য কাঁটাতারের বেড়াকে কখনওই 'প্রতিরক্ষা স্থাপনা' বলে মানতে চায়নি, তারা এটাকে 'আন্ত:সীমান্ত অপরাধ ঠেকানোর হাতিয়ার' হিসেবেই বরাবর বর্ণনা করে এসেছে।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার পাশে প্রহরারত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী
কিন্তু বাংলাদেশ এই বর্ণনার সঙ্গে একমত ছিল না, ফলে বেড়া বসানোকে কেন্দ্র করে স্থানীয় স্তরে বহু জায়গাতেই বিরোধ দেখা গেছে এবং দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সংঘাতে জড়িয়েছে।
২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে বিএসএফ ও বিজিবি মহাপরিচালকদের মধ্যে বৈঠকের পর বিএসএফ-এর তৎকালীন প্রধান রামন শ্রীবাস্তব জানিয়েছিলেন, তার কিছুদিন আগেই দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে বাংলাদেশ ভারতকে এই অনুমতি দিয়েছে যাতে সীমান্তের যেখানে অসুবিধা – সেখানে দেড়শো গজের মধ্যেও ভারত কাঁটাতারের বেড়া বসাতে পারবে।
ওই যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান মইনুল ইসলামও সেই বক্তব্যে সায় দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তার আগের বছরই বাংলাদেশে শেথ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে।
ফলে ২০১০ থেকে ভারত সীমান্তের অনেক জায়গাতেই জিরো লাইনের ১৫০ গজের ভেতরেও কাঁটাতারের বেড়া বসাতে পেরেছে।
গত রবিবার (১২ জানুয়ারি) বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বর্তমান উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও স্বীকার করেছেন, শেখ হাসিনার আমলে ভারতকে এই অনুমতি 'লিখিত আকারে' দেওয়া হয়েছিল।

ছবির উৎস, MOHA BD
ছবির ক্যাপশান,
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
এই অনুমতির সুযোগ নিয়েই ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সীমান্তের অন্তত ১৬০টি স্থানে ভারত (দেড়শো গজের মধ্যে) কাঁটাতারের বেড়া বসাতে পেরেছে বলেও তিনি দাবি করেন।
১৯৮৯ সালে ভারত যখন বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে শুরু করে, তখন বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও অনুমতি চাওয়া হয়নি, যার ফলে অনুমতি পাওয়ারও কোনও প্রশ্ন ছিল না।
ভারতের যুক্তি ছিল তারা সীমান্তে নিজেদের দিকে ও নিজেদের ভূখন্ডে বেড়া বসাচ্ছে, কাজেই অন্য পক্ষকে তা জানানোর বা তাদের সম্মতি চাওয়ার কোনও দরকার নেই।
ভারতের এই 'একতরফা পদক্ষেপ' বাংলাদেশের পছন্দ না হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এর বিরুদ্ধে কখনও তারা ভারতের কাছে বা কোনও আন্তর্জাতিক ফোরামে কখনও প্রতিবাদও জানায়নি।
তবে বাংলাদেশের একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ ও প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, "বাংলাদেশ কখনওই চায়নি দুটো বন্ধু দেশের সীমান্তে কাঁটাতার বসানো হোক। প্রথম দিন থেকেই আমরা এই বেড়ার বিপক্ষে, এখনও তাইই আছি।"
মি আলী যখন এই মন্তব্য করছেন, তিনি তখন দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার – শেখ হাসিনার আমলে যে পদে তিনি ছিলেন পাঁচ বছরেরও বেশি সময়।

ছবির ক্যাপশান,
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, যখন দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন (২০১৪-২০১৯)
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী অবশ্য এটাও বলেছিলেন, বেড়া বসানোর ফলে একদিকে অবশ্য বাংলাদেশের 'সুবিধে'ই হয়েছে – কারণ ভারত থেকে গরুর চালান অনেক কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ গরু উৎপাদনে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পেরেছে।
"তবে ভারত যে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর প্রধান যুক্তিতে কাঁটাতারের বেড়া বসিয়েছিল, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সেই অনুপ্রবেশ ঘটার আর কোনও কারণই নেই।"
"এখন সেই কারণগুলোই যদি না-থাকে, তাহলে সেই বেড়াটাও তো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, তাই না?", আরও বলেছিলেন মি আলী।
তবে শেখ হাসিনার আমলেই যে ভারতকে সীমান্তের দেড়শো গজের মধ্যে বেড়া বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, বর্তমান বাংলাদেশ সরকারও সে কথা স্বীকার করেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সেই সঙ্গেই জানিয়েছেন যে এখন থেকে 'নিয়ম ভেঙে' কোথাও ভারতকে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে দেওয়া হবে না – সেরকম চেষ্টা হলে বিজিবিও তাতে বাধা দেবে।
"তবে এখানে একটা বড় সমস্যা হইল, যেহেতু আগের সরকার ইন রাইটিং বা লিখিত দিয়া গেসে ... এই জায়গায় এইটা করতে পারবা, ওই জায়গায় ওইটা করতে পারবা। এইগুলা তাদের দেওয়াটা উচিত হয় নাই", আরও বলেন তিনি।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
দিওয়ালি আর ঈদে উপহার ও মিষ্টি বিনিময় করে থাকেন বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা
তার কথা থেকে স্পষ্ট, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার কাঁটাতারের বেড়া বসানোর প্রশ্নে ভারতকে কোনও ছাড় দিতে বা শিথিলতা দেখাতে প্রস্তুত নয়।
কিন্তু বিগত সরকারের দেওয়া অনুমতি তারা প্রত্যাহার করতে চান কি না, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সেই বিষয়টি স্পষ্ট করেননি।
কাঁটাতারের বেড়া আসলে এমন একটি ইস্যু, যা নিয়ে ভারতের সীমান্ত অঞ্চলের মানুষজনের মধ্যে তো বটেই –এ দেশের অ্যাকাডেমিক ও বিশ্লেষকদের মধ্যেও পরিষ্কার দ্বিমত আছে।
রিপোর্টিংয়ের কাজে বাংলাদেশ সীমান্তের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম বা মিজোরাম যেখানেই গিয়েছি সেখানেই দেখেছি ভারতীয়রা কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে ভাল ও মন্দ, দুরকম মতামতই দিয়েছেন।
সীমান্তে বেড়া দেওয়ার ফলে অপরাধ বা চোরাকারবারে রাশ টানা গেছে – কিংবা গরিব গ্রামবাসীদের গোয়াল থেকে গরু-বাছুর চুরি করে সীমান্তের অন্য পারে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক কমেছে, এটা তারা অনেকেই স্বীকার করেছেন।
কিন্তু বেড়া দেওয়ার ফলে যাদের কৃষিজমি কাঁটাতারের অন্য দিকে পড়েছে, বিশেষ করে তারা এটা নিয়ে যথারীতি খুবই ক্ষুব্ধ।
বিএসএফের দেওয়া বিশেষ পারমিট নিয়ে তারা এখন দিনে মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য জমিতে চাষ করতে যেতে পারেন – কিন্তু মাঝেসাঝেই নানা অজুহাতে ফেন্সিংয়ের গেট খোলা হয় না বা জমির ধান চোখের সামনে লুঠ হয়ে যায় – তাদের এই অভিযোগও কান পাতলেই শোনা যায়।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
বিএসএফকে পারমিট দেখিয়ে বেড়া পেরোতে যাচ্ছেন একজন গ্রামবাসী। আগরতলার কাছে
বেড়া বসানো হলে তারা ভারতের মানচিত্রের বাইরে ছিটকে যাবেন, এই আশঙ্কায় বছরকয়েক আগে মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলসের লিংখং নামে সীমান্তবর্তী একটি গ্রামের বাসিন্দারা তো কাঁটাতার লাগাতেই দেননি!
ভারতের দিকে গ্রামবাসীদের বাধায় বেড়া বসানোর কাজ আটকে গেছে, এমন ঘটনা আরও বহু এলাকাতেই ঘটেছে।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও ঢাকায় নিযুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মুচকুন্দ দুবে প্রায়ই বলতেন, "এই কাঁটাতারের বেড়া জিনিসটা একটা মান্ধাতার আমলের কনসেপ্ট, এটা একুশ শতকে একেবারেই চলতে পারে না!"
"প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো মেক্সিকো আর আমেরিকার মধ্যে দেওয়াল তুলেছেন, সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু আমি মনে করি ভারত যখন বাংলাদেশ সীমান্তে বেড়া দেয় তার মধ্যে একটা চরম স্ববিরোধিতা থাকে – কারণ আমরা একদিকে দোস্তির স্লোগান দেব আর অন্য দিকে বর্ডারে দেওয়াল খাড়া করব, দুটো এক সঙ্গে হয় না", অভিমত ছিল মি দুবের।
অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (অধুনা প্রয়াত) ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্য আবার যুক্তি দিতেন, "এই ফেন্সিং যে সীমান্তে অনেক ধরনের নেতিবাচক কাজকর্ম ঠেকাতে পেরেছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই!"
তার বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশ-ভারত উন্মুক্ত সীমান্তের চরিত্রটাই এমন যে এখানে নানা ধরনের আন্ত:সীমান্ত অপরাধ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক – আর সেটা ঠেকানোর জন্য কাঁটাতারের বেড়ার চেয়ে ভাল কোনও বিকল্প ভারতের হাতে নেই।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
ত্রিপুরা সীমান্তে টহল দিচ্ছেন একজন বিএসএফ জওয়ান
অনেকটা একই কারণে বাংলাদেশকেও যে একটা পর্যায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কথা ভাবতে হয়েছিল, ভারতে কোনও কোনও পর্যবেক্ষক সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
২০২১ সালের ৩রা অগাস্ট ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার্লামেন্টে এক লিখিত জবাবে জানায়, বাংলাদেশ সীমান্তে তারা ৪০৯৭ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩১৪১ কিলোমিটার অংশে বেড়া বসাতে পেরেছে। পরবর্তী সাড়ে তিন বছরে কাজ অবশ্য আরও অল্প কিছুটা এগিয়েছে।
সীমান্তের যে অংশটায় বেড়া নেই ('আনফেন্সড') তার একটা কারণ হিসেবে পার্লামেন্টে জানানো হয়েছিল বেশ কয়েকটা অংশে নদীনালা বা জলাভূমি রয়েছে বলে সেখানে বেড়া দেওয়া সম্ভবই নয় (নন-ফিজিবল স্ট্রেচ) - এরকম ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি (যেমন ড্রোন, স্মার্ট ফেন্সিং বা সেন্সর) ব্যবহার করে কাঁটাতারের বেড়ার অভাব পূরণ করা হচ্ছে।
তবে সীমান্তের এমন কিছু অংশ আছে যেখানে বেড়া দেওয়া সম্ভব (ফিজিবল স্ট্রেচ) – কিন্তু নানা কারণে সেখানে আজ পর্যন্ত বেড়া বসানোই যায়নি।
উল্লিখিত এই কারণগুলোর মধ্যে ছিল - অন্য দেশের পক্ষ থেকে ফায়ারিং ও বাধা দেওয়া, ডিফিকাল্ট টেরেইন বা দুর্গম ভূপ্রকৃতি, বর্ষার কারণে কোনও কোনও জায়গায় কাজ করার সময়ের স্বল্পতা, জমি অধিগ্রহণজনিত সমস্যা, স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিবাদ, কোভিড মহামারি পরিস্থিতি ইত্যাদি।
বিএসএফের সাবেক মহাপরিচালক পি কে মিশ্রর মতে, এর মধ্যে গ্রামবাসীদের জমি অধিগ্রহণের চ্যালেঞ্জটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা, আর এটা সবচেয়ে প্রকট পশ্চিমবঙ্গে – যে রাজ্যটির সঙ্গে বাংলাদেশের ২২০০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সীমান্ত আছে।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন মিয়ানমার সীমান্তেও সরকার কাঁটাতারের বেড়া বসাবে
পি কে মিশ্রর কথায়, "নিয়ম মেনে কাঁটাতারের বেড়া বসাতে গেলে বহু জায়গাতেই গ্রামবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে এবং তাদের কৃষিজমির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।"
"এখানে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের একটা বড় ভূমিকা থাকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি তারা বরাবরই এই কাজটা করার ক্ষেত্রে উদাসীন বা নিষ্ক্রিয়!"
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিরোধী দল বিজেপিও রাজ্যে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বারেবারে অভিযোগ তুলেছে, তারা সীমান্তে জমি অধিগ্রহণে বাধা দিচ্ছে বলেই রাজ্যের বহু জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া বসানো যায়নি।
তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে – এই মুহুর্তে বাংলাদেশের দিক থেকে আপত্তি আর বাধাটাই ভারতের জন্য জমি অধিগ্রহণের চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে উঠতে চলেছে।
গত ১২ জানুয়ারি ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশ জানিয়ে দিয়েছে, সীমান্তের দেড়শো গজের মধ্যে এবং বাংলাদেশকে না জানিয়ে কোনও স্থাপনা তৈরি করা হলে তা মেনে নেওয়া হবে না।
একই দিনে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীও মোটামুটি একই ধরনের বার্তা দিয়েছেন।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
পেট্রাপোল সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার অন্য পারে কাজ সেরে ফিরছেন ভারতের একদল কৃষক (ফাইল ছবি)
এর ঠিক পরদিনই দিল্লিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে পাল্টা তলব করে সীমান্ত ইস্যু নিয়ে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে দেওয়া হয়।
১৩ জানুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশকে এটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সীমান্তে তারা দুই দেশের মধ্যেকার সব প্রোটোকল ও এগ্রিমেন্ট মেনেই কাজ করছে – আর একটি 'ক্রাইম ফ্রি' বা অপরাধমুক্ত সীমান্ত গড়ে তুলতে নিজেদের অঙ্গীকারেও অবিচল আছে।
দুই দেশের এই ধরনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট – ভারত তাদের পরিকল্পনামাফিক সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ চালিয়ে যেতে চাইছে এবং বাংলাদেশও তাতে এখন সক্রিয়ভাবে বাধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইতিমধ্যে কাঁটাতারের বেড়া বসানো ও সীমান্ত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশেও জনমত আরও জোরালো হচ্ছে। দিনকয়েক আগেই ফেলানি খাতুনের হত্যাকান্ডের বার্ষিকীতে ঢাকায় বিভিন্ন সংগঠন এই ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে।
বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ ভারতের জন্য কখনওই সহজ ছিল না। তবে আগামী দিনে তা যে আরও অনেক কঠিন হয়ে উঠতে চলেছে, এই ইঙ্গিত স্পষ্ট!