স্যার ওরা আমাকে মাসের পর মাস গুম করে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করেছে। এখন নিজেদের লিখে দেয়া কথা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে মারধর করছে। আমাকে বাঁচান স্যার। আমি কোনো অপরাধী না। সামনে আমার পরীক্ষা। বিচারকের আসনে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটকে এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন দুই বছর গুম হয়ে থাকা এক যুবক। কিন্তু বিচারক তার কথা না শুনে উল্টো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বলেছিলেন, ‘এ কাকে নিয়ে আসছেন, এ তো স্বীকারোক্তি না দিয়ে উল্টো আপনাদের বদনাম করছে।’ এরপর ওই যুবককে আবার ধরে নিয়ে চালানো হয় ভয়ঙ্কর নির্যাতন। বলা হয় ‘তুই স্বীকার না করলেও আমরা যেটা লিখবো সেটাই হবে, আর করলে তো ভালো কথা। এরপর শুধু তোকে না তোর স্ত্রীকেও ধরে আনবো। এখানে আইন বলে কিছু নেই।’

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের বক্তব্যে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : অ্যা স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরো নামের প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিটি বাহিনীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনের একটি অংশে বলা হয়, দুই বছর গুম করে রাখা এক ব্যক্তিকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বলা হয়। এর জন্য তাকে একটি স্ক্রিপ্ট লিখে দেয়া হয়। ৩-৪ দিন সময় দেয়া হয় ওই স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতে। তখন ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আপনারা যা লিখেছেন, আমি এর কিছুই জানি না। আমি কিছুই করিনি। তখন তাকে বলা হয় তুই স্বীকারোক্তি না দিলে তোর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে আসব। তার সামনে তোকে নির্যাতন করব। তাতেও রাজি না হলে তোর সামনে তাকে নির্যাতন করব। আমাদের এখানে কোনো আইন নেই। আমরা সবই করতে পারি। এরপরও রাজি না হলে ক্রসফায়ার তো রয়েছেই। এভাবেই ৩-৪ দিন চলতে থাকে মানসিক নির্যাতন। তবে বন্ধ থাকেনি শারীরিক নির্যাতন।

৫-৬ দিন পর তাকে খুব গোপনীয়তার সাথে নেয়া হয় একটি আদালতে। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বলা হয়। কিন্তু ওই ব্যক্তি কৌশলে ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে আলাদা কথা বলতে চান। ভেবেছিলেন, ম্যাজিস্ট্রেটকে সব কথা খুলে বললে তিনি তাকে উদ্ধার করবেন। কারণ এখানেই তো বিচারের জায়গা। এখানে বিচার না পেলে আর কোথায় পাবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটলো তার উল্টো। তিনি বললেন, স্যার এরা আমাকে দুই বছর গুম করে রেখেছে। এই দুই বছর নির্যাতন করতে করতে আমাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। আজ কিছু মিথ্যা কথা নিজেরা লিখে আমাকে দিয়ে মুখস্থ করিয়ে আপনার সামনে স্বীকার করতে বলেছে। স্যার আমাকে বাঁচান। আমি কোনো জঙ্গি নই। এর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমার পরিবারকে খবর দেয়ার ব্যবস্থা করেন স্যার। ম্যাজিস্ট্রেট তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ডাকলেন। বললেন এ কাকে নিয়ে আসছেন। এ তো কোনো কথা স্বীকার করে না, উল্টো আপনাদের নামে বদনাম করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এরপর ওই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালানো হয়। তাকে যে আদালতে হাজির করা হয়েছিল সেটি কেউ জানতে পারেনি। তবে তিনি যদি স্বীকার করতেন তাহলে হয়তো তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে পরিবারকে জানানো হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিএফআই, র‌্যাব, সিটিটিসি, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্যরা গুমের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের নির্ধারিত ম্যাজিস্ট্রেট ছিল। এই ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের কথায় উঠবস করতো। গুম হওয়া এসব আসামিকে কোর্টে হাজির করা হতো মূলত ওইসব ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। যার কারণে ভুক্তভোগীরা আদালতের কাছে কোনো সুবিচার পেতেন না।

অপর একটি জবানবন্দীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ২০ মাস আগে গুম করে রাখা আসামিদের আদালতে হাজির করা হলে জজ আসামিদের কাছে জানতে চান তার কোনো উকিল আছে কি না। আসামি উকিল না থাকার কথা জানালে জজ তাদেরই কথা বলতে বলেন। তখন একজন নিজেকে ২০ মাস আগে আটক করে গুম করে রাখা হয়েছে বলে জানান। বিষয়টি পুলিশের কাছে জানতে চাইলে, পুলিশ জজকে জানায়, ‘তাদের গতকালই আটক করা হয়েছে। দেখেন তাদের গোঁফ কাটা ও পরিষ্কার কাপড় পরা। তখন আসামি বলেন, পুলিশ মিথ্যা বলছে, আদালতে হাজির করা হবে বলেই গোঁফ ছেঁটে পরিষ্কার কাপড় পরানো হয়েছে। তিনি আদালতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে যে আটকে রাখছে আমার পরিবারের কেউ জানে না। তারা এও জানে না যে আমি বেঁচে আছি। স্যার আমাকে আপনি বাঁচান। আমি এই মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিবো না।

তখন ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, আপনার ঘরে তো একটা লাইব্রেরি আছে তাই না, সেখানে কিছু বই রাখা আছে, আপনি ওই বই পড়েন, মাঝে মধ্যে বন্ধুরাও এসে সেখানে বই পড়ে। আমি ম্যাজিস্ট্রেটের কথায় সায় দিতে থাকি। কারণ আমার লাইব্রেরি ও বই রয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি ম্যাজিস্ট্রেট ওই বইগুলোকে জিহাদি বই হিসেবে উল্লেখ করছেন। ওই স্বীকারোক্তিতে স্বাক্ষর করতে না চাইলে তিনি বলেন ‘তোমার এত জায়গাজমি নেই যে আমি লিখে নিয়ে যাবো। এখানে কাগজে সাইন করতে বলছি, সাইন করো।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার অনেকেই জানেন না তাদের কোন বাহিনীর কোন সংস্থার সদস্যরা গুম করে রেখেছে। তাদের চোখ এমনভাবে বেঁধে রাখা হয় যে কোনটা দিন আর কোন রাত সেটা বোঝার উপায় থাকে না। শুধু বলা হয় এখন রাত ঘুমাও। আবার সকালে বলা হয় এখন দিন। তবে কেউ কেউ বলেছেন, তাদের পুলিশের মাধ্যমে আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে, কারা আটক করেছিল জানি না। তবে আমাদের কাছে র‌্যাব সদস্যরা তোমাকে হস্তান্তর করে গেছে। তবে অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, ডিজিএফআই যাদেরকে গুম করে রেখেছিল তাদের কাউকে কাউকে ছাড়ার সময় র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করেছে। তারা আবার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে আদালতে পাঠিয়েছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews