নতুন প্রভাত। নতুন সূর্যোদয়। নতুন আশা। বাংলাদেশের ফুটবলে গতকালের সকাল ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে এক অভূতপূর্ব ম্যাচ উপহার দিয়েছেন লাল-সবুজের জার্সিধারীরা। যে ম্যাচের পর দুই দলের কোচই বলছেন, বাংলাদেশ ভালো খেলেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ভালো খেলতেই পারে। সে কয়েক মিনিটের জন্য। এমনটা আগেও তো হয়েছে। কিন্তু পুরো ম্যাচ? আয়তন, জনসংখ্যা, ফিফা র্যাঙ্কিং কিংবা অন্য যে কোনো দিক দিয়েই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। তারপরও কীভাবে এমন একটা ম্যাচ খেলল বাংলাদেশ? যেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল আধিপত্য দেখিয়েছেন হামজা-রাকিবরা? তবে কী ফুটবলে আঁধার কেটে আলোর পথে ছুটতে শুরু করেছে বাংলাদেশ?
প্রায় দশ বছর আগে ২০১৫ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পর ফুটবলের কফিনে অনেকেই শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছিলেন। অনেকেই এপিটাফও লিখে দিয়েছিলেন। ধ্বংসস্তূপের নিচেই চাপা পড়েছিল বাংলাদেশের ফুটবল। এরপর শুরু হয় ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে ফুটবলকে বের করে আনার মিশন। সেই মিশনে যোগ হয় বসুন্ধরা কিংস। দলটির জন্য বসুন্ধরা গ্রুপ বিশ্বমানের ফ্যাসিলিটি গড়ে তোলে। সেরা কোচদের নিয়ে আসে। বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার এই ক্লাবে নাম লেখান। ব্রাজিলের সর্বোচ্চ লিগে খেলা ফুটবলার আসেন। জাতীয় দলের বেশির ভাগ ফুটবলার বসুন্ধরা কিংসের বিশ্ব মানের ফ্যাসিলিটিতে অনুশীলন করে নিজেদের গড়ে তোলেন। তারা পাশে পান ড্যানিল কলিনড্রেস আর রবসন রবিনহোদের মতো ফুটবলারদের। জেমি ডে’র অধীনে বাংলাদেশের ফুটবল অন্ধকার থেকে আলোতে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। এই চেষ্টায় যোগ হন হাভিয়ের কাবরেরা। স্প্যানিশ এ কোচ ঠান্ডা মাথায় সব সমালোচনা উপেক্ষা করে নিজের মতো করে দলটাকে নিয়ে এগিয়ে চলেন। ২০২২ সালে নিয়ে যান সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে। এবার কাবরেরার লক্ষ্য এশিয়ান কাপ খেলা। সেই লক্ষ্য পূরণ হবে কি?
ভারতীয়রা বলছে, তোমাদের খেলা অনেক ভালো হয়েছে। অনেক উন্নতি করেছ তোমরা। তারা এভাবেও বলতে পারত, ভারতের দিনটি ভালো ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলের নিয়মিত দর্শকদের জন্য এমনটা বলা মোটেও উচিত হবে না। যে দল ডিফেন্সে এলোমেলো ফুটবল খেলে। মিডফিল্ডে কোনো নিয়ন্ত্রণই থাকত না। ফরোয়ার্ড লাইনে আক্রমণে গেলেও দিক হারায়। সেই দলটাই কি না দেখিয়ে দিল জমাট বাঁধা বরফের মতো ডিফেন্স লাইন! জ্যামিতির প্যাঁচের মতো মিডফিল্ড। ফরোয়ার্ড লাইনে এখনো অনেক দুর্বলতা। তবে উন্নতিটা তো নিচ থেকেই হয়! ডিফেন্স আর মিডফিল্ড সামলে নিতে পারলে কাবরেরার জন্য ফরোয়ার্ড লাইনে বেশি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হবে। হয়তো তিনি সফলও হয়ে উঠবেন দ্রুত!
বাংলাদেশ যে ফুটবলে নতুন জামানার সূচনা করেছে, তার কারিগর নিঃসন্দেহে কাবরেরা। তবে এই সূচনালগ্নের নায়ক হামজা দেওয়ান চৌধুরী। যিনি তার মায়ের দেশকে বিশ্ব ফুটবলে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাবার গুরু দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সত্যিই তিনি স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব নিয়েছেন। ভারতের বিপক্ষে পরশুর ম্যাচটার কথাই ধরা যাক। লাল-সবুজের জার্সিতে এটা ছিল হামজার প্রথম ম্যাচ। অধিনায়কের দায়িত্ব ছিল তপু-রহমত-সোহেলদের কাঁধে। কিন্তু ম্যাচের বেশির ভাগ সময় দলটাকে পরিচালনা করলেন হামজা। কোথায় পাস দিতে হবে। কোথায় গিয়ে খেলতে হবে। নিজের কাজটা যেমন করলেন, তেমনি সতীর্থদেরটাও আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। মিডফিল্ডে নিখুঁত পাস দিলেন। গোলের সুযোগ তৈরি করলেন। ডিফেন্সে নেমে ট্যাকল করলেন। ব্লক করলেন। এ কারণেই কোচ কাবরেরা ম্যাচের পর বলেছেন, হামজা যেভাবে ম্যাচটা নিয়ন্ত্রণ করেছে তা সত্যিই অসাধারণ ছিল।
স্বপ্নপূরণের পথে হামজা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। গত পরশুর ম্যাচের পর কাবরেরার এশিয়ান কাপ খেলার স্বপ্ন এখন আর খুব বেশি দূরে বলে মনে হয় না। সামনেই সিঙ্গাপুর ম্যাচ। আছে হংকংও। এ দুটি দলকে টপকাতে পারলেই তো মনজিলে মকসুদে পৌঁছে যাবে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। গতকাল শিলং থেকে ঢাকা ফিরেছে বাংলাদেশ দল। হামজা চলে গেছেন লন্ডনে।