ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতারতের নাম কে না শুনেছেন। দাপুটে এই প্রেসিডেন্ট এখন নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বিচারাধীন রয়েছেন। সেখানে বন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। গত মার্চ মাসে ইন্টারপোল থেকে ওয়ারেন্ট জারি হলে ফিলিপাইনের বর্তমান সরকার তাকে ম্যানিলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে হেগে পাঠিয়ে দেয়।

দুতারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মাদকবিরোধী অভিযানের নামে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছেন। বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাঠগড়ায়। ঠিক দুতারতের স্টাইলেই ২০১৮ সালে বাংলাদেশেও একটি মাদকবিরোধী অভিযান সূচিত হয়। এ অভিযানে এ পর্যন্ত কত লোক প্রাণ হারিয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। হত্যার শিকার সবাই ছিল তথাকথিত মাদক কারবারি। পিলখানায় বিডিআর হত্যা, শাপলা চত্বরে হেফাজতের নেতাকর্মীদের হত্যা এবং ২০২৪-এর গণহত্যা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলেও তথাকথিত মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হয় না। কেন হয় না তাও জানি না। তা ছাড়া এটি নিয়ে কোনো পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো তদন্তের কিংবা বিচারের দাবি ওঠেনি। তবে ওই অভিযান চলাকালে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছিল।

এ ধরনের অভিযানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, কোনো তদন্ত না করে শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে হত্যাকাণ্ড চালানো। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের অভিযানের পেছনে সবসময় একটি অভিসন্ধি লুকিয়ে থাকে। সে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা সফলতার মুখ দেখেনি। আমাদের জানা ইতিহাসের অন্যতম বড় তিনটি অভিযানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সেগুলো হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের মাদকযুদ্ধ। যেমন- ১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সেই মাদকযুদ্ধের কথাই ধরা যাক। তিনি ওই বছর ১৭ জুন আমেরিকায় মাদকযুদ্ধের ঘোষণা দেন। সেই যুদ্ধের এখন ৫৪ বছর পার হচ্ছে। এখনো আমেরিকায় সে যুদ্ধ চলছে। যদিও তার তীব্রতা আগের মতো নেই। সত্তর ও আশির দশকে এই যুদ্ধ ছিল তুঙ্গে। তখন শুধু গাঁজা সেবন ও মাদক আইন ভঙ্গ করার জন্য লাখ লাখ মানুষকে জেল দেয়া হয়েছিল।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে, মার্কিন এই মাদকযুদ্ধটা মূলত শুরু করা হয়েছিল কালো মানুষ ও লাতিন আমেরিকার হিপপিদের বিরুদ্ধে। যেমন করে ১৮৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে আফিম আইন করা হয়েছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী চীনাদের বিরুদ্ধে। আবার ১৯২০ সালে গাঁজাবিরোধী যে আইন করা হয়েছিল তার মূল লক্ষ্য ছিল মেক্সিকান আমেরিকানরা। এ সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের অভিসন্ধিটা ১৯২০ সালে প্রকাশ করে দেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের শীর্ষ স্থানীয় একজন সহকারী। তার নাম এরলিসম্যান। তিনি মাদকযুদ্ধের ওপর লিখিত একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, কৃষ্ণাঙ্গ ও হিপপীদের লক্ষ্য করেই এই যুদ্ধ শুরু করা হয়েছিল।

থাইল্যান্ডের মাদকবিরোধী যুদ্ধটা ছিল খুবই ভয়াবহ। ২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা এই যুদ্ধ সূচনা করেছিলেন। সে সময় মাত্র তিন মাসে দুই হাজার ৮০০ জনের মতো মাদক কারবারি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। পরে এ ব্যাপারে একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে, নিহতদের অর্ধেকেরই কোনো মাদকসংশ্লিষ্টতা ছিল না। মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের এই রক্তাক্ত ক্রাকডাউনের পরও মিয়ানমারের সাথে সংযুক্ত মাদক রুট অটুট ছিল। যদিও থাকসিন যুদ্ধকে বিরাট সফল হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

থাইল্যান্ডের মাদকযুদ্ধ শুরু করা ছিল অবিবেচকের মতো। কারণ অতীতে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ কিংবা নিরাপত্তা বাহিনী মূল গডফাদারদের খুঁজে না পেয়ে অতি নিচের দিকে সাধারণ বাহক বা ছোট মাদক কারবারিকে হত্যা করে কৃতিত্ব নিয়ে থাকে। সেটা কলম্বিয়া ও মেক্সিকোতে ঘটেছে। এর থেকে শিক্ষা না নিয়ে থাইল্যান্ড যে অভিযান চালিয়েছিল সে ক্ষেত্রেও একই ঘটনা লক্ষ করা গেছে।

একইভাবে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতারতে নিজে আসিয়ানভুক্ত দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্তে¡ও অন্য আরেকটি আসিয়ানভুক্ত দেশের অভিজ্ঞতা গ্রহণ করেননি; অর্থাৎ তিনি থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতাটা গ্রহণ না করে একই স্টাইলে ফিলিপাইনে মাদকযুদ্ধ শুরু করেন। যার অবধারিত ফলাফল ছিল ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু; অর্থাৎ ১০ হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছিল, যাদের অধিকাংশ ছিল নিরপরাধ। মাদক চোরাচালানি কারবারটা অনেকটা পিরামিডের মতো। সবার ওপরে শীর্ষবিন্দুতে বসে থাকেন বস। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। সবচেয়ে নিচে থাকা কারবারিরা পুলিশের নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হয় সহজেই।

ঠিক একইভাবে ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা না করে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতারতে স্টাইলে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেন। শুরুতে এই মাদকযুদ্ধের অভিঘাত এত প্রচণ্ড ছিল যে, মাত্র কয়েক মাসে ২০০-এর মতো কথিত মাদক কারবারি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। হত্যার ধরন দেখে মনে হয়েছে অভিযান শুরুর আগে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য ছিল না, ছিল না তেমন কোনো প্রস্তুতি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews