তাবলীগ জামাত

সাদপন্থি ও জুবায়েরপন্থি: মত, পথ ও ভাবাদর্শের লড়াই

আমাদের মনে ধারণা গেড়ে বসে আছে– তাবলিগ কর্মীরা কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় আচার পালনে সীমাবদ্ধ; দুনিয়াদারি নিয়ে তারা বেখেয়াল। কিন্তু ধর্মের মামলা স্রেফ ধর্মীয় আচারে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার সঙ্গে থাকে সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি। থাকে মত চাপিয়ে দেওয়া কিংবা আধিপত্য বিস্তারের যোগ। তাবলিগ জামাতের সর্ববৃহৎ বার্ষিক জমায়েত ‘বিশ্ব ইজতেমা’ ময়দানে বুধবার ‘সাদপন্থি’ বনাম ‘জুবায়েরপন্থি’ সংঘাতে চারজন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেটা আরেকবার প্রমাণ হলো।  

বস্তুত ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে ধর্মযুদ্ধের কাহিনি; মত-পথ ও ভাবাদর্শের লড়াই। ধর্মের নামে ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার ইতিহাসও পুরোনো। তাই তাবলিগ জামাতের সাম্প্রতিক বিভাজন ও বিবাদ নিছক ইজতেমা ময়দান দখলের উদ্দেশ্যে সংঘটিত– এমন নয়। অতীতের ভাবাদর্শিক লড়াইগুলোর মতো এখানেও রয়েছে নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার জবরদস্তি কিংবা অন্যকে মুছে ফেলার রাজনীতি।

তাবলিগ জামাতে বিভাজনের সূত্রপাত দৃশ্যত ২০১৬ সালে মাওলানা সাদ কান্ধলভির একটি ফতোয়াকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেছিলেন, ইসলামী শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নেওয়া জায়েজ নয়। কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা জুবায়েরের নেতৃত্বে তাবলিগেরই কিছু আলেম এই মতের বিরোধিতা করেন। এ থেকেই সৃষ্টি হয় ‘সাদপন্থি’ ও ‘জুবায়েরপন্থি’ ধারা।

স্বাভাবিকভাবেই তাবলিগ জামাতের ভেতর ও বাইরের অনেকে ধর্মী শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ না নেওয়ার ফতোয়ায় সিঁদুরে মেঘ দেখেছেন। কারণ, ধর্ম শিক্ষা দিয়ে কিংবা ধর্মীয় বক্তা হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন– এমন আলেম-ওলামার সংখ্যা দেশে নেহাত কম নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্যের প্রশ্নও জড়িত। ফলে বিষয়টি সহজেই মিটে যায়নি। যত দিন গেছে, বিরোধ বেড়েছে। এক পর্যায়ে তা গড়িয়েছে বিবাদে। পারস্পরিক শক্তি প্রদর্শন ক্রমেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন তাবলিগ জামাতের দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পেয়েছিল ২০১৭ সালের নভেম্বরে সংগঠনটির মূল কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে দু’দল কর্মীর হাতাহাতির মধ্য দিয়ে। তার পর দু’পক্ষ পরস্পরকে ‘নিষিদ্ধ’ করার ঘোষণাও দিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বিশ্ব ইজতেমাও আলাদা হয়ে গেছে। এখন সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। হাতাহাতি পৌঁছে গেছে হত্যাকাণ্ডে।

প্রাচীন গ্রিক সমাজেও এ ধরনের বিতর্ক ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে সোফিস্ট নামে একটি দার্শনিক দল গড়ে ওঠে। তারা ছিল প্লেটোর সমসাময়িক। জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে তারাই প্রথম দিককার দার্শনিক গোষ্ঠী, যারা শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ বা টাকাকড়ির দাবি তুলেছিল। মজার ব্যাপার, প্লেটো, জেনোফন এই রীতির সমালোচনা করেছিলেন; কিন্তু অ্যারিস্টটল টাকার বিনিময়ে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে শিক্ষা দিতেন। এদিক থেকে অ্যারিস্টটলও সোফিস্ট। 

যাই হোক, ফতোয়া নিয়ে ভারতবর্ষে বিতর্কও দীর্ঘদিনের। ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষে ইসলামপন্থি দুটি দলের মধ্যে ব্রিটিশ শাসন নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। এক পক্ষ ফতোয়া দিয়েছিল– ভারতবর্ষ যেহেতু বিধর্মীরা শাসন করছে, সেটি ‘দারুল হারব’ বা যুদ্ধের ময়দান। অন্য একটি দল বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিল– যেহেতু এখানে ইসলামচর্চায় শাসকের কোনো বাধানিষেধ নেই; সুতরাং এটি ‘দারুল ইসলাম’।

তাবলিগ জামাতের এই বিভাজনের স্বরূপ বুঝতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্ম স্রেফ দৈনন্দিন জীবনে আচার পালনের ব্যাপার নয়। এটি মত-পথ-আদর্শ ইত্যাদি মিলেই রাজনৈতিক মামলা। বিশেষত ভারতবর্ষের ইতিহাসে ইসলাম ও মুসলিম বর্গটি যতটা ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। বাংলাদেশেও সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতা অস্বীকারের সুযোগ নেই। এই বোঝাপড়া একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে না হলে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। তাবলিগ জামাতের বিরোধকে যেভাবে ‘আইনশৃঙ্খলা’ ইস্যু হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেটাও অর্ধেক বাস্তবতা অস্বীকারের নামান্তর।

বাস্তবতা হলো, ফতোয়া কিংবা বিভিন্ন ঘরানার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এ সমাজে থাকবেই। কারণ, আমরা এই ঐতিহাসিক মামলা ঐতিহাসিক নিরিখে বিচার করে রাষ্ট্র প্রকল্প দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছি। বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদ করে ভাবার কথা পশ্চিমা সেক্যুলারিজম থেকে ধার করেছেন বটে; ইউরোপ ও ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ বিকাশ প্রক্রিয়া ও ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল যেভাবে নিজেদের সুবিধার্থে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠীকে কাছে টেনেছে বা দূরে ঠেলে দিয়েছে, তাতে বিভাজন আরও বেড়েছে। 

বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এমনকি তাবলিগ কর্মীদের অরাজনৈতিক বলে যে তকমা দেওয়া হয়, তাতেও বিভাজন রয়ে যায়। মাজারপন্থি গোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই ক’দিন আগেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজারে হামলা ও লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বস্তরের ঘরানা, মত, পথ ও ভাবাদর্শের মানুষ নিয়ে রাষ্ট্র প্রকল্প গড়ে তুলতে না পারলে তাবলিগ জামাতের সাদপন্থি ও জুবায়েরপন্থিদের মতো অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীতেও বিভাজন ও বিবাদের বহু সমস্যা দেখা দিতেই থাকবে। 

সমাজে বহু মত ও ঘরানা থাকাই স্বাভাবিক। যে কোনো ধরনের অপরায়ন কিংবা বিভাজনের রাজনীতি সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে। পাহাড়ি-বাঙালি কিংবা আদিবাসী-বাঙালি, সংখ্যালগু-সংখ্যাগুরুর ধারণা বিভাজিত ও অপরায়ন সমাজের বহিঃপ্রকাশ। বহুত্ববাদের চর্চার মধ্য দিয়েই সমাজ মীমাংসার পথে এগোতে পারে।

তাবলিগ নিয়ে আমাদের পুরোনো ধারণা ভাঙতে হবে। তারাও দেশের রাজনীতির শরিক। তাদের এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের নিরসন রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। 

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল

Iftekarulbd@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews