ঢাকা: হোক রুগ্ণ দশা, পুঁজিপাট্টা ঠিক থাক না থাক, ঈদে কর্মচারীদের বেতন-বোনাস লাগবেই। শিল্পকারখানার মালিকদের তা শোধ করতেই হবে।



এ প্রবণতা বেশি তৈরি পোশাকশিল্পে। হালবাস্তবতা জানার পরও শ্রমিকনেতাদের দাবি, এটি মালিকদের চাতুরি-কারসাজি। উৎপাদন ব্যয়, বৈশ্বিক ক্রেতার চাহিদা এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকলেও উৎসবের সময় এলে শ্রমিকদের জিম্মি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন শিল্পমালিকরা। কর্মসংস্থানের কথা বলে তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা হাতান। মাঠ কাঁপানো না হলেও শ্রমিকদের খ্যাপাতে যথেষ্ট তাঁদের এ যুক্তি। তাঁরাও জানেন, রাজনৈতিক ঘটনার অনিবার্যতায় বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকগুলোতে প্রোডাকশন তলানিতে নেমে গেছে, তবে তা বিষয় নয় তাঁদের কাছে। বিবেচ্যও নয়। ছোট বড় সব প্রতিষ্ঠানের জন্যই ঈদে বেতন-বোনাস দেওয়ার বাধ্যবাধকতা অবধারিত। গার্মেন্ট, নির্মাণসহ বিভিন্ন শিল্পে যার যার জায়গায় সমস্যার সমাধানে দিশাহারা অবস্থা। ঈদ সেখানে একটা ধাক্কা দিয়েছে।

ঈদের আগে চলতি মার্চ মাসের বেতন ও বোনাসের চাপ থাকা স্বাভাবিক। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ২০ রোজার মধ্যে পুরো মাসের বেতন, ২৫ রোজার মধ্যে বোনাস পরিশোধের দাবি তোলা বেতন-বোনাসহয়েছে। গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিকরা নানা ইস্যুতে তেজি হয়ে উঠছেন। আর তেজি হওয়া মানে কাজ ক্ষান্ত রেখে রাস্তা আটকে কিছুক্ষণ হট্টগোল বাধানো। ততক্ষণে সড়ক-মহাসড়কে যে অবস্থা তৈরি হয় ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের পক্ষে উপলব্ধি অসম্ভব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ না করে বুঝিয়ে শুনিয়ে তাঁদের কাজে ফেরাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ করুক, গন্ডগোল পাকুক- সেই অপেক্ষা মহলবিশেষের। সরকার সেই সুযোগটা দিতে চায় না।

ঈদের আগে অস্থিরতা সৃষ্টির একটি আয়োজন সম্পর্কে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক-বিনিয়োগকারীরাও ওয়াকিবহাল। তাঁরা এ ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে শক্ত পদক্ষেপ চান। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত সেই পথে যেতে নারাজ। বিষয়টির সঙ্গে টাকার প্রশ্ন। শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন টাকার জন্য। টাকা দিলে আন্দোলন করবে না- তা সরকার জানে। বিজনেস কমিউনিটিও জানে। তারা ঈদের আগে বেতন-বোনাসের চাপে চ্যাপটাা থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে নগদ সহায়তা চেয়েছে। সরকারের দেওয়া প্রণোদনার বড় অঙ্ক এখনো আটকে রয়েছে। সরকারের দিক থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে চুপ থাকার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ সংকটে ব্যাংকগুলোকেও পাশে চান ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেশির ভাগ শিল্পকারখানা দুর্বল হয়ে পড়েছে। কমে গেছে উৎপাদন। সরকারি প্রকল্পগুলোও স্থবির হয়ে পড়ায় আয়-রোজগার কমে গেছে এসব প্রকল্পে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্তদের। বাঘা বাঘারা পালিয়েছেন রাজনৈতিক কারণে। তাঁদের মাধ্যমে টাকার যে ঘূর্ণি ঘটত সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তৈরি পোশাকশিল্প কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও তাঁরা চ্যাপটা হয়ে চলছেন কাঁচামাল আমদানি ও জ্বালানি সংকটে। পোশাকশিল্পে অর্ডার বাড়লেও কিছু কারখানা লসে ডেলিভারি দিচ্ছে এমন তথ্য জানান দিচ্ছে বায়ারদের কাছে। এতে বিভিন্ন কারখানায় নগদ অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। এটিও এক ধরনের অসুস্থতা। যে পরিমাণ রপ্তানি হয়, সেই পরিমাণে টাকা আসছে না। তাই লাভের মার্জিন ঠিক থাকছে না। যন্ত্রণা সব দিকেই। কারখানা চালু রাখতে কর্মী দরকার। জ্বালানি বিশেষ করে গ্যাসও দরকার। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে প্রতি ইউনিট ১১ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। এর পরও গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। গ্যাস সংকটে ডিজেল দিয়ে ডায়িং কারখানায় উৎপাদন করা গেলেও স্ট্যান্ডার্ড ও ড্রাক করা যাচ্ছে না। আর ফ্যাব্রিকস ডায়িং করাতে না পেরে সুইং, ফিনিশিং, নিটিং অ্যান্ড প্রিন্টিং সেকশনের শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। ভারতের আগ্রাসন ও সুতা অ্যান্টিডাম্পিং করার ফলে চলতি বছর রোজার ঈদে স্থানীয় বাজারে প্রায় দেড় শ কোটি ডলারের পণ্য অবিক্রীত থাকবে। ভারত সরকার তাদের উদ্যোক্তাদের সুতা উৎপাদনে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে ৩০ শতাংশ বেশি সুতা আমদানি করেছেন। এতে ডাম্পিং হচ্ছে দেশীয় সুতা। পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। এই খাতের প্রায় দুই লাখ শ্রমিকের নিয়মিত মজুরিই পরিশোধ করা যাচ্ছে না। কেবল প্রবৃদ্ধি নয়, যেকোনো খাতের গতিশীলতা ধরে রাখতে শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। নতুন বিনিয়োগ পরের ব্যাপার।

বিদ্যমান বিনিয়োগই হুমকিতে পড়লে আর ভরসা থাকে না। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর। প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। হোক তা ব্যক্তি খাতে বা রাষ্ট্রীয় খাতে। সাম্প্রতিক বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট বড় মাঝারি সব ব্যবসায়ীই কমবেশি আক্রান্ত। দেশের গোটা অর্থনীতিই নানা চ্যালেঞ্জে খাবি খাচ্ছে। ছোট-বড় সব ব্যবসাই বাড়তি ঝুঁকিতে। শিল্প, ব্যবসা, বিনিয়োগ- সবকিছুই স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। স্বাভাবিকতা ফেরাতে ঋণের সুদহার কমানো, ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা, ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাসহ একগুচ্ছ দাবিতে অনেক দিন থেকে মাথা ঠুঁকছেন ব্যবসায়ীরা। গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চয়তাও পায়নি। ঋণের সুদের হার বাড়ানোর ফলে ব্যবসাবাণিজ্যের খরচ বেড়ে গেছে। এতে পণ্যের দামও বাড়ছে। ফলে বিক্রি কমে গেছে। এখনো এলসি খোলার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে। অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে চাচ্ছে না। এলসি খোলার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হচ্ছে। দেশের বাইরে ব্যবসায়িক কার্যালয় স্থাপন করতে গেলেও কঠোরতা। বিদ্যমান নীতিমালা কিছুটা হলেও শিথিল করা দরকার। এতে আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগ বাড়বে। এ ছাড়া দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়বদ্ধতা বাড়ানোর বিষয় রয়েছে।

দেশের টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, প্লাস্টিক এক্সেসরিসসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা সেদিন কিছুটা  নির্ভয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে তাঁদের কিছু যন্ত্রণার কথা বলেছেন। বৈঠকে তাঁরা আমদানি-রপ্তানিতে নানা প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি ভ্যাট-ট্যাক্স ও আমদানি শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে কমানোর প্রস্তাব দেন। বন্ড জটিলতা, চোরাচালানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কাস্টমসের হয়রানি বন্ধ করার দাবিও জানান। জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অনিয়মের দুরারোগ্য ব্যাধি এত সহজে দূর হবে না। তবে কাজ উদ্ধারে ব্যবসায়ীদের এনবিআরের কর্মকর্তাদের অন্যায় আবদার না মানার পরামর্শ দেন তিনি। একপর্যায়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ উদ্ধারে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ না দিয়ে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। দুর্নীতির প্রমাণসহ কেউ হাতেনাতে ধরা পড়লে তদন্ত ছাড়াই এনবিআর কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার হুঁশিয়ারিও দেন। ব্যবসায়ীরা এনবিআর বা কোনো দপ্তরের কর্মকর্তাকে ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে কেন? এটা তাঁদের কাজ নয়। তাঁরা চায় স্বস্তিতে-আনডিস্টার্বে বিনিয়োগ করতে। আর রাষ্ট্রের কাছে তাঁদের চাওয়া সেই বিনিয়োগ তথা পুঁজির নিশ্চয়তা।

বিনিয়োগ-ব্যবসা মিলিয়ে অর্থনীতির শিরায় রক্তপ্রবাহ না থাকলে রাজনীতি-গণতন্ত্র গতিময়তা পায় না। যুগে যুগে তা প্রমাণের বাকি নেই। আধুনিক বিশ্বে অর্থনীতি-গণতন্ত্র দুই চাকার সাইকেলের মতো। যেকোনো এক চাকায় সাইকেল চালানো যায় না। দেশ অর্থনীতিবান্ধব না হলে রাজনীতি গণতন্ত্র বান্ধব হবে না। কেবল বাংলাদেশ নয়, এটি গোটা বিশ্বের বাস্তবতা। নির্বাচনসহ চলমান রাজনীতি নিয়ে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের কারণ খোঁজা তাই জরুরি। এরপরই না বাদবাকি অন্য কিছু। ভঙ্গুর আর্থিক খাত, বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ এবং নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে এমনিতে বিপাকে অন্তর্বর্তী সরকার। তার ওপর রয়েছে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান। ছোট-বড় মিলিয়ে বিজনেস কমিউনিটিতে এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। সরকার ও রাজনৈতিক মহলে নিশ্চয়ই এ বিশ্লেষণের মাত্রা যোগ আরও বেশি। বিশেষ করে অর্থযোগে চাপে চ্যাপটা হওয়ার লক্ষণ দেশ, রাজনীতি, গণতন্ত্রের জন্য আরও বেশি।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ১২০৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৫

এসআইএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews