এখন আমরা বলছি, ইউনিভার্সিটি অব এক্সিলেন্স। অথচ আগে এই ধারণা দিয়েই ইউরোপের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলেছে। সেখানে তাদের বিদ্যা শেখার কেন্দ্রে ছিল নির্মোহ শিক্ষা। যেটিকে প্রাচীনকালে বলা হতো ফিলোসফি। জ্ঞানের জন্য প্রেম। এই জ্ঞানের প্রেম দিয়ে আমরা কী করব? মানুষের কল্যাণ করব। শুধু নিজের নয়। নিজের কল্যাণের পরে নিজের দেশ ও সমাজের কল্যাণ এবং তারপরে পৃথিবীর কল্যাণ করব। এই ক্রমেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে বিন্যস্ত করেছি। কিন্তু সেই শিক্ষা এখন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে।

প্লেটো কেন শহর থেকে অনেক দূরে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়েছিলেন? একটা কারণ হচ্ছে, সমাজের যে কোলাহল, যে হট্টগোল, এগুলো থেকে বাইরে গিয়ে চিন্তা করা। রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদল প্রতিদিনই হয়। সে অনুসারে প্রতিদিন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার বিষয় বদলাতে হয়, কার নামে জিন্দাবাদ দেব, কার নামে মুর্দাবাদ দেব, সেটা যদি বদলাতে হয়; তাহলে নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ জ্ঞানচর্চা ব্যাহত হবে। এ জন্য ‘একাডেমিক ফ্রিডম’ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই নির্ধারণ করবেন তাঁরা কী পড়াবেন, ছাত্ররাই নির্ধারণ করবেন যে শিক্ষকেরা তাঁদের কীভাবে পড়াবেন।

জজ মাকদিসির আরেকটি বইয়ের (দ্য রাইজ অব কলেজেস) সারকথা বলি। তিনি বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল নিরপেক্ষ জ্ঞানচর্চার জন্য। কোনো শাসকের তোষামোদ করার জন্য নয়। স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ইতালি, ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড ঘুরে আমাদের দেশে এসেছে। আমাদের দেশে যখন বিশ্ববিদ্যালয় এসেছে, তখন আমরা পরাধীন। আমাদের দেশে শিক্ষা ছিল পরাধীন দেশের লোকদের সরকারি চাকরি পাওয়ার একটা প্রধান মাধ্যম। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই পূর্ব বাংলা ছিল মোটামুটি চাষাভুষা বা কৃষকসমাজ। পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা কলকাতায় গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চর্চা শুরু করতেন। কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় ৬০ বছর পর ঢাবি প্রতিষ্ঠা হয়। এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাইভেট বলা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইভেট বা পাবলিক হয় না। এটা হয় দশের সম্পত্তি। এ জন্যই ট্রাস্টি বোর্ড থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে আপনারা কেউ সচিবালয়ে কাজ করবেন, কেউ ব্যাংকে কাজ করবেন, কেউ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন, কেউ দেশের বাইরে যাবেন, কেউ বাসায় থাকবেন। এসব জায়গাতেই শেখা যায়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাটা একটু আলাদা। এখানে আমরা চার, পাঁচ, ছয় বা সাত বছর থাকি। এখানে আমরা শুধু শিখি না। সমাজকে কী করে ন্যায়, মুক্তির পথ, স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করতে পারি, সেই শিক্ষাটাও আমরা নিই। এই জন্য আমাদের আইন আমাদেরই রচনা করার ক্ষমতা সমাজ দিয়েছে। এটা দরকার।

অন্যান্য স্কুল–কলেজ যেভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে, বিশ্ববিদ্যালয় চলে না কেন? কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয় যে ন্যায়ের পথের সংগ্রামে জয়ী হতে পারে, সেটা আমরা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তের মাধ্যমে দেখেছি। ঢাবির একমাত্র গৌরব ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশ নেওয়া। সেই কাহিনি আমরা বেশি একটা বলি না। প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাবিকে উদাহরণ হিসেবে ধরছি। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান এর আগেও হয়েছে। নারীশিক্ষার জন্য ১৮৭৩ সালে ঢাকার ইডেন মহিলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা কলেজ হয়েছে ১৮৪১ সালে। কিন্তু ১৯২১ সালে ঢাবি ও পরে তার অনুকরণে পাকিস্তান আমলে ৫-৬টি বিশ্ববিদ্যালয় হয়। এখন বেড়ে শ খানেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। আপনারা এখন জিজ্ঞাসা করবেন, আমরা যে ঐতিহ্য থেকে জন্মেছি, সেই ঐতিহ্যের মান রক্ষা করতে পারছি না। তার চেয়ে ভালো করতে পারছি না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, এখন আপনারা কর্মক্ষেত্রে বেরোবেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা কখনোই ভুলতে পারবেন না। চিরকালই এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য থাকবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় যা দিয়েছে, তাকে শতগুণে জীবনে বহন করে নিয়ে গিয়ে বর্ধিত করাই আমাদের কর্তব্য।

গত ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে অনেক জ্ঞানী, গুণী এবং প্রতিভাবান ছাত্রের সংস্পর্শে এসেছি। এটা শুধু পেশা নয়। তারও অধিক। আমরা শুধু চাকরি করার জন্য আসি না। আমাদের আরেকটা উচ্চাশা থাকে। আমরা যাদের তৈরি করছি, তারা একদিন দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। সেটা ইতিমধ্যে হচ্ছে। এটা আমাদের বড় পুরস্কার।

আপনাদের অনুষ্ঠানকে বলা হচ্ছে ‘কনভোকেশন’। লাতিন থেকে আসা ‘কন’ শব্দের অর্থ একসঙ্গে। ‘ভোকেশন’ মানে ডাকা। যেটাকে আমরা বলি, আপনাকে জীবন ডাকছে। আমরা যারা উপাধি (ডিগ্রি) পেলাম, জীবন আমাদের ডাকছে দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য। আমি বলি, শিক্ষকদের ভোকেশন হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবা করার মধ্য দিয়ে তাঁরা শুধু চাকরি করেন না, তাঁরা ভবিষ্যৎ জীবনের নেতাদের নির্মাণ করেন। বেতন দিয়ে এ পুরস্কার হয় না। আশা করি, এআইইউবির নামের অর্থ যা–ই হোক না কেন, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাবেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews